অধ্যবসায়ীদের অনুপ্রেরণার নাম মাদাম কুরী

মাদাম কুরী
শেয়ার করুন:

অধ্যবসায়ীদের অনুপ্রেরণার নাম মাদাম কুরী
মোঃ কায়ছার আলী
সীমাহীন ব্যর্থতা, দারিদ্রতা এবং হতাশার অতল গহব্বরে নিমজ্জিত থেকে বিশ্বসেরা হয়ে সফলতার স্বর্ণোজ্জল ইতিহাস গড়ে নিজের নাম অনেকর মত কর্মের মাধ্যমে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ করেছেন, তিনি হলেন জীবন সংগ্রামে জয়ী, বিশ্বশান্তি ও নৈতিকতার অগ্রদূত মহীয়সী বিজ্ঞানী মাদাম কুরী। ১৮৬৭ সালের ৭ ই নভেম্বর পোল্যান্ডের ওয়ারাশতে এক হত দরিদ্র কৃষক পরিবারে তাঁর জন্ম। চার বোনের মধ্যে ছোট্ট মেরী শৈশবেই মাকে হারান এবং তাদের বাবা স্বাধীনতা আন্দোলনে সহায়তা করার জন্য স্কুলে চাকুরীচ্যুত হন। সে সময় তিনি স্কুলের সেরা ছাত্রী হওয়ায় এবং শেষ পরীক্ষায় অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য স্বর্ণপদক পান। অত্যধিক পড়াশোনার চাপ, সাধনা আর সংগ্রাম ছিল তাঁর নিত্য ছায়া সঙ্গী। দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত তিনি ক্ষুধার জ্বালায় প্রায়ই বেহুশ হয়ে পড়তেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি গৃহশিক্ষিকা থাকাকালীন ধনী পরিবারের এক ছেলে তাঁর আচার আচরণে স্বভাব চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে প্রণয় থেকে পরিণয়ের প্রস্তাব দিলে গৃহকর্তীর অসহ্য তিরস্কারে তিনি দিশেহারা হয়ে জীবনের লক্ষ্য বদলে ফেলেন। প্যারিসে পাড়ি দিয়ে দারিদ্র্যতাকে মহান ভেবে বিজ্ঞানে লেখাপড়া এবং গবেষণার মাত্রায় নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করেন। রান্না বান্নার কাজে সময় অপচয় হবে ভেবে যৎসামান্য খেতেন। এর ফলে তাঁর মাথা ঘুরতো এবং বিছানায় বেহুশ হয়ে পড়ে থাকতে হত। মাঝে মাঝে ক্লাসে তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলতেন। বন্ধু বান্ধবদের সাথে বেশী সময় তিনি অপচয় করতেন না, কেননা তিনি জানতেন সময় জীবনে অত্যন্ত মূল্যবান। বোর্ডিং এ চতুর্থ তলায় যে কক্ষে তিনি থাকতেন সেখানে পর্যাপ্ত আলো, শীতের দিনে কক্ষ গরম করার কোনটাই ব্যবস্থা ছিল না। ঠান্ডায় আংগুলগুলো বরফের মত জমে যেত, ঠক ঠক করে হাত পাগুলো কাঁপতো কিন্তু এসব তিনি মোটেই আমলে নিতেন না। মোট কথা শীত নিবারণ আর শরীর গরম রাখার জন্য রাতে শরীরের ওপর পুস্তকের স্তুপ চাপিয়ে দিতেন। লেখাপড়া নিয়ে তন্ময় থাকায় ক্ষুধার কথা তিনি ভূলে যেতেন। কেননা তাঁর পেটের ক্ষুধার চেয়েও মনের অদম্য ক্ষুধা ও ভিতরের দাহ জ্বালা ঠান্ডা হবার ছিল না। পদার্থ বিদ্যার পর অংকেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষায় প্রথম হন। অধ্যাপক পিয়েরে কুর্রী কোন নারী প্রতি নয়,বিজ্ঞানের প্রতি ছিল তাঁর জীবনের প্রবল আকর্ষন।পারস্পরিক কথাবার্তা বিনিময়ের পর তাঁরা বন্ধুত্ব থেকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বামীর ল্যাবরেটরিতে দিনে বেশির ভাগ সময় কাটাত মেরী। বিয়ের সময় তাঁদের সম্পদ বলতে দুটি সাইকেল ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সাইকেল দুটিতে চড়ে তাঁরা দুজনে হানিমুন করতে ফ্রান্সের পাড়া গাঁয়ে বেরিয়ে পড়তেন,সামান্য পরিমাণে খাদ্যদ্রব্য নিয়ে।১৮৯৭ সালে তাঁদের প্রথম সন্তান আইরিন এর জন্ম হয়।সন্তান জন্মের কিছুদিন পর ১৮৯৮ থেকে ১৯০২ এই ৪৫ মাস তাঁরা দুজনেই দিনমজুরের মত অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন।১৯০৩ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে “পোলোনিয়াম” আবিস্কারের জন্য তাঁরা যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান। বিদেশ থেকেও নিজের জন্মভূমির প্রতি মেরীর ছিল অকৃত্রিম ভালবাসা। তাই নিজের দেশ পোল্যান্ডের নাম অনুসারে দ্রব্যটির নাম রাখেন “পোলোনিয়াম”। নোবেল পুরস্কার এর অর্থ দিয়ে গবেষণা চলাকালীন ঋণ পরিশোধ এবং বাকী অর্থ গবেষণার জন্য ব্যয় করেন। দ্বিতীয় কণ্যা ইভ এর জন্মের পর ১৯০৪ সালে বৃষ্টিভেজা পথে পিছলে পড়ে মালবাহী গাড়ির ধাক্কায় রক্তাক্ত হয়ে মারা যান পিয়েরে কুরী। স্বামীর মৃত্যুর পর শোককে শক্তিতে পরিণত করে আবার গবেষণার মনোনিবেশ করলেন মেরী কুরী। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা অধ্যাপক ড: মেরী কুরী। ১৯১১ সালে “রেডিয়াম” আবিষ্কার এর জন্য তিনি রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি দুইবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এবং তাঁদের পরিবার একমাত্র পরিবার মেয়ে জামাই সহ তাঁরা ৫ বার নোবেল পুরস্কার পান। তাঁদের পরিবারের প্রতি পৃথিবীবাসীর ঋণের শেষ নেই। মাডাম কুরী শুধু একজন সফল বিজ্ঞানীই ছিলেন না, একাধারে ছিলেন নিবেদিত স্ত্রী, একজন দায়িত্বশীল মা এবং একজন মানবদরদী। পিয়েরে কুরীর সাহচর্যে যে তেজস্ক্রিয় ভালবাসার সূচনা হয়েছিল তার সমাপ্তি ঘটে পিয়েরে কুরীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। মাদাম কুরী প্রথা ভেংগে বিশ্বজয় করেছিলেন কেননা তখন মেয়েদের পোল্যান্ডের ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কোন সুযোগ ছিল না। মানবজাতির জন্য তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তেজস্ক্রিয় মৌল রেডিয়াম আবিষ্কার এবং মানবদেহের ওপর এর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করায় তাঁর শেষ পরিণতি হয় করুণ যন্ত্রণাদায়ক মরণব্যাধিতে অসহ্য মৃত্যু । তিনি নিজে অসহনীয় ব্যাথা সহ্য করে মানুষকে ব্যাথামুক্ত জীবন দান করেছেন। ক্যান্সার চিকিৎসায় রেডিয়াম সবচেয়ে ফলপ্রদ প্রতিষেধক। সারাজীবন বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী মাদাম কুরী। অসাধারণ এবং মহামানবদের মত বিস্ময়কর আবিষ্কারকে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত না করে মানবসেবায় উৎসর্গকরে গবেষণাগার দেশে বিদেশে তৈরী করে তা ব্যয় করেছেন। তাঁরই আবিস্কৃত সন্তানতুল্য “রেডিয়াম” তাঁকে চিরদিনের জন্য ১৯৩৪ সালের ৪ঠা জুলাই তাঁর জীবনদ্বীপ নির্বাপিত করে। তাঁর ব্যবহৃত সবকিছুই ছিল অত্যন্ত তেজস্ক্রিয়। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দেহ থেকে যেন তেজস্ক্রিয়তা ছড়াতে না পারে সে জন্য তাঁর কফিনটি এক ইঞ্চি সীসা দিয়ে আবৃত করে দেওয়া হয়।

শেয়ার করুন: