ঢাকার ইউনূস সেন্টার থেকে গতকাল বিকেলে পাঠানো এক বিবৃতির মাধ্যমে ১৮ জন নোবেল বিজয়ী এবং পৃথিবীর আরও বিশিষ্ট ব্যক্তির খোলা চিঠির বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। চিঠিতে নোবেল বিজয়ীরা উল্লেখ করেছেন- আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সম্ভাব্য সব হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানাচ্ছি, যাতে নিরীহ বেসামরিক মানুষদের ওপর নির্বিচার সামরিক আক্রমণ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়, যার ফলে এই অসহায় মানুষগুলোকে নিজ দেশ ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যেতে এবং রাষ্ট্রহীন মানুষে পরিণত হতে না হয়।
চিঠিতে মায়ানমার থেকে শরণার্থী প্রবাহ বন্ধ ও তাদের ফিরিয়ে নেয়া, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান, জাতিসংঘের ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপন ও পীড়িত এলাকা পরিদর্শনসহ ৭ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
খোলা চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনূস, বেটি উইলিয়ান্স, মেইরিড মাগুইর, আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু, অসকার আরিয়াস সানচেজ, জোডি উইলিয়ান্স, শিরিন এবাদি, লেইমাহ বোয়ি, তাওয়াক্কল কারমান, মালালা ইউসুফ জাই, স্যার রিচার্ড জে. রবার্টস ও এলিজাবেথ ব্ল্যাকবার্ন। তাদের সঙ্গে স্বাক্ষরকারী বিশ্ব ব্যক্তিত্বরা হলেনÑ মালয়েশিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়েদ হামিদ আলবার, ইতালির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমা বোনিনো, ব্যবসায়ী নেতা ও সমাজসেবী স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন, নরওয়ের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গ্রো হারলেম ব্রানডটল্যান্ড, উদ্যোক্তা ও সমাজসেবী মো. ইব্রাহীম, মানবাধিকার কর্মীকেরী কেনেডি, লিবীয় নারী অধিকার প্রবক্তা এসডিজি সমর্থক আলা মুরাবিত, ব্যবসায়ী নেতা নারায়ণ মুর্তি, থাইল্যান্ডের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাসিত পিরামিয়া, আসিয়ানের সাবেক মহাসচিব সুরিন পিটসুয়ান, ব্যবসায়ী নেতা এসডিজি সমর্থক পল পোলম্যান, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট ম্যারি রবিনসন, জাতিসংঘ সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সালিউশান্স নেটওয়ার্ক পরিচালক জেফরে ডি. সাচ, অভিনেতা ফরেস্ট হুইটেকার, ব্যবসায়ী নেতা ও সমাজকর্মী জোকেন জাইটজ, অভিনেত্রী শাবানা আজমি, কবি ও গীতিকার জাভেদ আখতার এবং পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান আসমা জাহাঙ্গীর।
খোলা চিঠিতে তারা বলেন, রোহিঙ্গা সংকট পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহ্বান করার জন্য প্রথমে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমরা আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই যে, মায়ানমারের রাখাইন এলাকায় মানবীয় ট্র্যাজেডি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ যে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে তার অবসানে আপনাদের জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। আপনাদের এই মুহূর্তের দৃঢ়সংকল্প ও সাহসী সিদ্ধান্তের ওপর মানব ইতিহাসের ভবিষ্যৎ গতিপথ অনেকটাই নির্ভর করছে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, রাখাইন রাজ্যে মায়ানমার সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক আক্রমণে শত শত রোহিঙ্গা জনগণ নিহত হচ্ছে জানিয়ে চিঠিতে আরও বলা হয়, লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। বহু গ্রাম সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, বেসামরিক মানুষদের নির্বিচারে আটক করা হচ্ছে এবং শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। আতঙ্কের বিষয়, মানবিক সাহায্য সংস্থাগুলোকে এই এলাকায় প্রায় একেবারেই প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না, যার ফলে দারিদ্র্যপীড়িত এই এলাকায় মানবিক সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। স্থানীয় সরকার সূত্রগুলোর মতে, গত দুই সপ্তাহে তিন লাখেরও বেশি মানুষ তাদের জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মৃত্যুর মুখে নারী, পুরুষ ও শিশুদের এই ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি ও অভিবাসন থেকে সৃষ্ট পরিস্থিতি প্রতিদিন আরও খারাপ হচ্ছে।
চিঠিতে বলা হয়, সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি পেলে গত বছরের শেষে আমরা কয়েকজন নোবেল লরিয়েট ও বিশ্বের বিশিষ্ট নাগরিক এ বিষয়ে জরুরি হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি। পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে নিরীহ নাগরিকদের ওপর অত্যাচার বন্ধ এবং রাখাইন এলাকায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আমরা আবারও আপনাদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।
আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সম্ভাব্য সব হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানাচ্ছি, যাতে নিরীহ বেসামরিক মানুষদের ওপর নির্বিচার সামরিক আক্রমণ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়, যার ফলে এই অসহায় মানুষগুলোকে নিজ দেশ ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যেতে এবং রাষ্ট্রহীন মানুষে পরিণত হতে না হয়।
সবাই আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য ৭টি প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেন। যার মধ্যে আনান কমিশনের সদস্যদের নিয়ে অবিলম্বে একটি ‘বাস্তবায়ন কমিটি’ গঠন করা, যার কাজ হবে কমিশনে সুপারিশগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন তত্ত্বাবধায়ন করা, দেশটি থেকে শরণার্থীর প্রবাহ বন্ধ করতে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের নিয়মিতভাবে পীড়িত এলাকাগুলো পরিদর্শন করতে আমন্ত্রণ জানানো, যেসব শরণার্থী ইতোমধ্যে দেশ ত্যাগ করেছে তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা, ফিরে যাওয়া শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য জাতিসংঘের অর্থায়ন ও তত্ত্বাবধানে মায়ানমারে ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপন, বাস্তবায়ন কমিটি কর্তৃত্বে আনান কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান এবং রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অবাধে চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।