ইতিহাসে ফারাক্কা, বাংলাদেশ মরুকরণ ও বিহারে অতি বন্যা

শেয়ার করুন:
ফারাক্কা ভাটি ও উজানের জন্য সংকট। ভাটিতে বাংলাদেশ ও উজানে বিহার ফারাক্কা সংকট সৃষ্টি করেছে। ফারাক্কার কারণে বিহারে ব্যাপক বন্যা হয়। আবার ফারাক্কার কারণে বাংলাদেশে বন্যা ও পানি সংকটের সৃষ্টি হয়।  বলতে গেলে সারা বছরই বাংলাদেশের সংকটের কথা উঠে আসে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করলে তার প্রভাব পড়ে পরিবেশে। পদ্মা নদী নিয়ন্ত্রণের ফলে মনুষ্যসৃষ্ট এমনই এক বিপর্যয়ের নাম ফারাক্কা বাঁধ। ভারত এ বাঁধ নির্মাণের উপকারভোগী। আর এ বিপর্যয়ের শিকার বাংলাদেশ।
ভারত গ্রীষ্মকালে ইচ্ছেমতো পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় পদ্মা অববাহিকায় গোটা বাংলাদেশ পরিণত হয় মরুভূমিতে। অন্যদিকে বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ছাড়ার কারণে প্লাবিত হয় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল। তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করায় গোটা বছর এই পানি আগ্রাসনের নির্মম পরিণতি বয়ে বেড়াতে হয় বাংলাদেশের পদ্মা পাড়ের জনগণকে।
ইতিহাসে ফারাক্কা বাঁধ:
: ফারাক্কা বাঁধ পদ্মা (ভারতীয় অংশে গঙ্গা হিসেবে পরিচিত) নদীর ওপর অবস্থিত একটি বাঁধ। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে প্রায় সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দূরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় এই বাঁধটি অবস্থিত। ১৯৬১ সালে এই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। সেই বছর ২১ এপ্রিল থেকে বাঁধ চালু হয়। ফারাক্কা বাঁধ ২,২৪০ মিটার লম্বা। বাঁধ থেকে ভাগীরথী-হুগলি নদী পর্যন্ত ফিডার খালটির  দৈর্ঘ্য ২৫ মাইল। ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণ করে হিন্দুস্থান কন্সট্রাকশন কোম্পানি। শেঠ বালচাঁদ হিরাচাঁদের প্রতিষ্ঠিত এ কোম্পানির সদর দফতর মুম্বাই।
Image result for farakka barrage
ফারাক্কা বাঁধ ভারত তৈরি করে কলকাতা বন্দরকে পলি জমা থেকে রক্ষা করার জন্য। এ বাঁধের উদ্দেশ্য ছিল, একতরফা পানি প্রত্যাহার করে কলকাতা বন্দরের নাব্য রক্ষা। কলকাতা বন্দর সচল রাখতে শুষ্ক মৌসুমে (জানুয়ারি থেকে জুন) ফারাক্কা বাঁধ ফিডার খালের মাধ্যমে পদ্মার অধিকাংশ পানি হুগলি নদীর অভিমুখে চালিত করে।১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির মাধ্যমে ফারাক্কার বাঁধ চালু হয়। ১৯৭৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ফারাক্কা বাঁধের সবকটি গেট খুলে দেয় দেশটি, সেবারই মূলত চাহিদা অনুযায়ী পানি পেয়েছিল বাংলাদেশ।১৯৭৬ সালের ১৬ মে মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে সারা দেশের লাখ লাখ মানুষ রাজশাহী থেকে মরণবাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চে অংশগ্রহণ করেন।

ফারাক্কার কারণে ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ফারাক্কা এক মহাঅভিশাপ। যখন পানি প্রয়োজন অর্থাৎ শুষ্ক মৌসুমে পানি পায় না বাংলাদেশ। কিন্তু যখন বন্যার প্রাদুর্ভাব ঘটে অর্থাৎ, পানি যখন অভিশাপ হিসেবে নদীপাড়ের মানুষের কাছে আবির্ভূত হয়, তখন ভারতও এ বাঁধ খুলে দেয়। ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির বিশেষ অবনতি ঘটে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগে, শীতকালের শুষ্ক মৌসুমেও পদ্মা নদী থেকে ৪০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত পানি পেত বাংলাদেশ। কিন্তু ১৯৭৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত চাহিদানুযায়ী পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিতই রয়ে গেছে বাংলাদেশ। ফারাক্কার অভিশাপে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৯ ফুট উঁচুতে অবস্থিত রাজশাহীর গোদাগাড়ীসহ সমগ্র বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিনিয়তই নিচে নামছে। এতে অগভীর কোনো নলকূপ থেকে বর্তমানে কোনো পানি উঠছে না। মরুকরণের দিকে যাচ্ছে নদী অববাহিকার জনপদ।
সরকারি গবেষণায় দেখা গেছে, বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রতিবছর ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর স্থানভেদে ১-২ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে যাচ্ছে। এরমধ্যে ২০১০ সালে বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে খ্যাত গোদাগাড়ী এলাকায় পানির স্তর ছিল মাটির ১৯ ফুট গভীরে। ২০১১ সালে স্থানভেদে ১৯-২১ ফুট। ২০১২ সালে ২০-২৩ ফুট এবং ২০১৩ সালে পানির স্তর ছিল স্থানভেদে ২৩-২৫ ফুট মাটির গভীরে। চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশকে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি প্রদান করার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। শুষ্ক মৌসুমের এ সময়ে ভারত বাংলাদেশকে চুক্তি অনুযায়ী পানি প্রদান করলে পদ্মায় অন্তত পানি প্রবাহ থাকত। খরার দুর্যোগে আক্রান্ত হতো না বাংলাদেশ। কিন্তু তার বদলে অসময়ে বাঁধ খুলে দিয়ে ভারত দুই দেশের সীমান্তের দুই পাশের নদীকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠীকে বিপদে ফেলছে। কারণ, ফারাক্কা শুধু বাংলাদেশের নয়, ভারতের সীমান্তবর্তী মানুষদেরও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *