লেখক – অধ্যাপিকা ডক্টর হোসনে আরা বেগম ।।
২০২৪ সালের ৫-ই আগস্ট; ছাত্র-জনতার এক গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের প্রধান, সাংবিধানিকভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যিনি তৎকালীন পাকিস্থানের মন্ত্রী ছিলেন, তার সম্বন্ধে “তেরো মাসের গদির ফল, বলাকা সিনেমা হল” এই স্লোগান শুনতাম। তিনি পূর্ব বাংলার স্বাধিকার অর্জনের জন্য ১৪ বছর বিভিন্ন মেয়াদে কারাবরণ করা সহ এমন সংগ্রাম নাই যে করেন নাই। তৎকালীন শক্তিশালী পাকিস্থান থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য ভারতের আগরতলায় পরিকল্পনা, কলাকৌশল করায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলার উপক্রম হয়েছিল। সে সময়ের তারুণ্য, ছাত্র-জনতা সংগ্রাম করেই তাকে কারামুক্ত করেছিল, বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়েছিল। তারুণ্যের তাগুত এই উপমহাদেশের সকল উল্লেখযোগ্য আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে, তা সচেতন সকলের জানা। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এদেশের রাজনীতিতে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মমত্ববোধ, পরস্পরের আস্থাহীনতা, এমনকি জীবন বিধ্বংসী বৈরিতা বেড়ে যাওয়ায় দেশের সংবিধান সমুন্নত রাখার জন্য ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধির বাহিরেও জ্ঞানী-গুণী, প্রজ্ঞাবান সুশীল সমাজ দ্বারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচনকালীন সরকার তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সংবিধানভুক্ত করা হলো। তাদের নিয়ন্ত্রণে যে কয়বার ভোট হয়েছে পরাজিতদের ক্ষীণ উষ্মা, অধর্তব্য অভিযোগ ছাড়া নির্বাচন সর্বজন গ্রহণযোগ্য ছিল, দেশের মানুষের ভোটের প্রতি আস্থা ছিল, মত-দ্বিমত করার অধিকার কম-বেশি ছিল। ঐ নির্বাচনী ব্লকে ভোট প্রার্থীগণকে পছন্দ না হলে ‘না ভোট’ দেওয়ার সুযোগ ছিল। গত ৫ আগস্টে পদত্যাগ ও দেশত্যাগকারী সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করার পর কথিত স্বাধীন বিচার বিভাগের উচ্চ আদালতের বিচারক বিচারপতি খায়রুল হক সাতজন অ্যামিকাস কিউরি’র মতামতকে অগ্রাহ্য করে অগণতান্ত্রিক মানসিকতায় কেয়ারটেকার সরকারকে নাকচ করার পথ-পন্থা, সুযোগ-সুবিধামূলক রায় ক্ষমতাসীন সরকারের অনুকূলে দিলেন। ক্ষমতাসীন সরকার এই রায় চিপিয়ে, চুনিয়ে ভোটকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য কেয়ারটেকার তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করলেন। ২০১৪ সালে মেজরিটি নির্বাচনী আসনে বিনা ভোটে এমপি নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলের সরকার গঠন নিশ্চিত অবস্থায় মাইনোরিটি সংখ্যক আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বেশকিছু কেন্দ্রে একজন ভোটারও ভোট দিতে যায় নাই, কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা অপেক্ষাও বেশি ভোট পড়েছে। বিএনপি, ২০ দলের ভোট বর্জন, চরম বিরোধীতা, দুই মাসের অধিক কাল অবরোধ, প্রতিরোধ, ভাংচুর, জ্বালাও-পোড়াও ইত্যাদির মধ্যে দিয়েই এমপি নির্বাচন, পার্লামেন্ট গঠন, সরকার পরিচালন কিছুই বাদ থাকে নাই। তেমনি ২০১৮ সালে বিএনপি, ২০ দল ভোটে অংশগ্রহণ করলেও তারুণ্যের তাগুত অপেক্ষা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আস্কারায় ভোটারদের ভোট দেওয়ার প্রয়োজন হয় নাই। অনুরূপভাবে, ২০২৪ সালের ৭-ই জানুয়ারিতে বিএনপি’র ভোট বর্জন পরিস্থিতির মধ্যে ভোটারদের উপস্থিতি অতি নগণ্য হলেও ৫-১০ গুণ বেশি সংখ্যায় ভোটার উপস্থিতি হয়েছে মর্মে কাজী হাবিবুল আউয়াল (যিনি নিজ কমিশনের ক্ষমতা কমানোর জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন) নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দেওয়ায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করা অনেক প্রবীণ রাজনীতিবিদকে চিন্তিত দেখেছি, বলতে শুনেছি ‘এর পরিণাম ভালো না’। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের কৃতি সন্তান, জাতীয় যাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক, স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, ভারতের পদ্মশ্রী পদকপ্রাপ্ত, বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’ জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের প্রযোজক, সঞ্চালক, বঙ্গীয় শিল্পকলা চর্চার আন্তর্জাতিক কেন্দ্র (ICSBA) এর প্রতিষ্ঠাতা, টিএমএসএস এখতিয়ারধীন ড. এনামুল হক আর্ট অ্যান্ড কালচারাল একাডেমীর স্বপ্নদ্রষ্টা মরহুম ড. এনামুল হক নিরিবিলিভাবে আমাকে বলতেন, “আওয়ামীলীগ সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক এটা আমি চাই, কিন্তু ভোট ব্যবস্থা ভ-ুল করা, দেশের সকল সরকারি এবং স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভয়াবহভাবে ভঙ্গুর করার পরিণতি তুমি কি ভাবো?” আমি তাকে বলতাম, স্যার আমি তৃণমূল পর্যায়ের চিন্তা করেই সেরে উঠতে পারছি না, অনেক সমস্যায় জর্জরিত। স্যার বলতেন, রাষ্ট্রে সমস্যা থাকলে তৃণমূল পর্যায়ের সমস্যা, সংকটও বেড়ে যাবে, বৃদ্ধি পাবে, স্থায়ী হবে। তাঁর কথায় শঙ্কিত হয়ে আওয়ামীলীগ সরকারের নীতি-নির্ধারণী ব্যক্তিত্ব যাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ আছে তাদেরকে বলতে গেলে, বিশেষ করে মরহুম এইচ টি ইমাম বলতেন, “তোমার বাড়ি বগুড়া, এই Vulnerability তোমার জন্য বিশাল ভয়, এগুলো বলতে যেও না। এই বাঙালিরা সুযোগ পেলেই মাথায় উঠবে।” তাঁর সঙ্গে দেশ নিয়ে কথা বলার সময় বিশাল দেহধারী তার পুত্র তানভীর ইমাম তার বাবার সামনেই আমাকে বললেন, “আগামী সপ্তাহের মধ্যে কোটি খানিক টাকা দিয়ে যাবেন।” আমি বললাম, টিএমএসএস এ আমার আর্থিক ক্ষমতা এক লক্ষ টাকা, পিপিআর অনুসরণ করে প্রকিউরমেন্ট হয়, টুকিটাকি টাকা নিতে গেলেও ৪টা টেবিলে নথি যায়। বাপ-বেটা সমস্বরেই বলে উঠলেন “তোমার টিএমএসএস কি এতোই তুলসী ধোঁয়া।” একটু পরেই সিরাজগঞ্জের আব্দুল খালেক ও তার বোন সংরক্ষিত আসনের এমপি রুমে ঢুকে পড়লে ঐ জাতীয় পঁচা বাক্য বন্ধ হলো, মনের দুঃখে স্যারকে সালাম দিয়ে বের হয়ে আসলাম। এইচ টি ইমামের একমাত্র ছেলে উল্লাপাড়ার এমপি, সংস্থার কাজে সেখানে গেলে আমাদের সদস্য পরিবারের অনেকেই বললেন, তানভীর এমপি সাহেবকে টাকা না দিলে কিছুই হয় না, স্বাক্ষর দেয় না। ঐস্থান থেকেই তানভীর এমপি সাহেবকে ফোন দিয়ে বললাম, আপনার বাবা আর নাই, সেদিন আপনার বাবার সামনেই আপনার বচন শুনে অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম, আজকে আপনার নির্বাচনী এলাকার সাদা-সরল মানুষের অভিমত শুনেও কষ্ট পাচ্ছি, কষ্ট যেন আমার পিঁছু ছাড়ছে না। মুঠোফোনে তিনি হো হো হেঁসে আমাকে বললেন, “আপনি কবে আসবেন, আমাদের বনানীর বাসায় আসুন, আপনার সঙ্গে অনেক কথা আছে।” এই তানভীর ইমামও তরুণ, সর্বজনীনতায় তাগুত না দেখিয়ে আত্মকেন্দ্রিক ভাব-ভাবনায় ব্যস্ত।
প্রিয় পাঠক, ৫-ই আগস্টের অভাবনীয় ঘটনার পর সমগ্র দেশব্যাপী যা ঘটছে, তার নাম চুরি, ডাকাতি, লুটতরাজ, রাহাজানি, সন্ত্রাসী, মাস্তানী, প্রতিশোধ পরায়নতা। এগুলো ঘটছে সরকারবিহীন, পুলিশবিহীন বাংলাদেশে। মানুষের বন্ধু পুলিশকে কেন মারবে, থানার আসবাবপত্র, অফিস নথি কেন তছনছ হবে, নষ্ট হবে, চুরি হবে। আমার ঠেঙ্গামারা গ্রাম বিনোদন জগৎ এর পার্শ্ববর্তী পরহেজগার গ্রামবাসী নামে পরিচিত এলাকায় প্রত্যহ লাগাতার মসজিদ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে, “সরকারি অফিসের, উপজেলার আসবাবপত্র যারা নিয়ে এসেছেন, তা বিভিন্ন পাড়াস্থ মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনকে ফেরৎ দেওয়ার অনুরোধ করা যাচ্ছে।” এই প্রচারণাও আমার নিকট কলঙ্কময়, কষ্টময় অধ্যায়। কষ্ট যেন কোনোভাবেই পিঁছু ছাড়ছে না। পিতৃহারা ছিলাম, আত্মীয়-স্বজন, এলাকাবাসীর সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছি। তাদের মুখে শুনেছি, ‘পর ধন নাহি লবে, চিরদিন সুখে রবে’। এদেশের মানুষের নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ জলাঞ্জলী হলো কেন? বিচার বিভাগ কেঙ্গারু কোর্টে পরিণত হলো, ফরমায়েশি রায়, বিবেকহীন বিচার, বিচারকগণের অন্যায় অভিলাশ, শামসুদ্দিন মানিক মার্কা বিচারক আমলাদের Dictation–এ বিচার মূলত অবিচারের অতি আধিক্য। থানায় অসংখ্য মামলা, অভিজাত পদস্থ রাজনৈতিকদের বিরুদ্ধে লজ্জাজনক মামলায় আসামীকরণ, হাজার হাজার অজ্ঞাতনামা আসামীর বিপরীতে মামলা বাণিজ্য, জামিন বাণিজ্য, সমস্যা সৃষ্টি করে সমস্যার বাণিজ্য, ট্যাগ লাগান বাণিজ্য (রাজাকার, বিএনপি, জামায়াত, জঙ্গি), নীতি ব্যত্যয় করে নীতির বাণিজ্য, ইস্যুতে বিলম্ব করে বিলম্ব বাণিজ্য, মানবতা অপরাধ তুল্য অগণিত অপরাধ চলতে থাকল।
রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে আন্দোলন সংগ্রামে চূড়ান্ত সুফল না আসার কারণ, এই অপরাধগুলো কম-বেশি সকল রাজনৈতিক দলই করেছে। তাই গণমানুষের আস্থা, ভুক্তভোগীদের আস্থা তারুণ্যের উপর, ছাত্র-ছাত্রীদের উপর। এই তারুণ্যরা বয়সে তরুণ হলেও বুদ্ধিতে অনেক বোদ্ধা। তাইতো প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুস এর মতো আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদকে প্রধান করে যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেছেন, এতে তারুণ্যের জ্ঞানদীপ্ততায় তাজ্জব হতে হয়। কোনো কোনো প্রবীণ সচিব, পদস্থ আমলাগণ বলছেন, এই কম বয়সী তরুণকে স্যার বলতে শেকি হবো, এটাই সমস্যা। আমি তাদেরকে বলেছি, চেয়ারের কোনো বয়স নাই। যেকোনো বয়সের মানুষই ভারি চেয়ার পেলে তাকে ভারত্ব গণ্য করার নির্দেশ সকল ধর্মে-সভ্যতায় স্বীকৃত আছে। ইগোকে অগ্রাহ্য না করলে তারুণ্যের তাগুতে শক্তিশালী তখ্তে
-তাউসে ভেঙ্গে খান খান হবে। সাধু সাবধান!