অধ্যাপিকা ডক্টর হোসনে আরা বেগম ।।
সকল ধর্ম, সভ্যতা, সমাজ, ইথিকস্-এ নবীন, তারুণ্যকে প্রভূত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইসলাম ধর্মীয় ওস্তাদের কাছে শুনেছি যুব-নবীনদের নেক কাজ, ইবাদত বন্দেগী প্রবীণদের ইবাদত বন্দেগী অপেক্ষা সৃষ্টিকর্তার নিকট অধিক গ্রহণযোগ্য, দুনিয়াতেও ফলদায়ক। ২০২৪ সালে ৩৬ দিনে ঘটে যাওয়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, সংগ্রাম, অভ্যুত্থান, বিপ্লবে একটানা দেড় দশকের অধিক কাল সুরম্য, সুসজ্জিত শক্তিশালী শাসন ব্যবস্থা পড়ে গেলো, পরাজিত হলো, যার অন্যতম অগ্রবাহিনী ছিল তরুণ, যুব শিক্ষার্থী-জনতা, এর সঙ্গে অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত মন-মগজ এবং পাকস্থলীর ক্ষুধার্তরা। এই জনতার অভিপ্রায়, তাদের কষ্টে নাকি কান্নারও অধিকার ছিল না। তবে অদ্ভুত আয়না ঘর নামক যে জটিল প্রকোষ্ঠ ছিল, যারা দিন কখন রাত কখন বুঝতো না, অনুধাবন করতে পারত না, তাদের কান্নায় বিপত্তি হয় নাই, বাঁধা ছিল না। তাইতো দীর্ঘ বৎসর পর উক্ত জটিল প্রকোষ্ঠ থেকে আসা ব্যক্তিরা বলছেন, তাদের এক যুগের চোখের পানি পুকুর থেকেও বেশি হতো। হদিসবিহীন কারণে তাদের একজনের স্ত্রী অন্যত্র বিবাহ করে নতুন সংসার করছে, এগুলো কিছুই আয়না ঘরের বাসিন্দা জানতো না। শুনেছি দেড় যুগ পূর্বের শাসক গোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় হাওয়া ভবন ছিল, সেখানে রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা প্রশিক্ষণের নামে নাকি কাজের পারসেনটেজ নেওয়া হতো, কিন্তু সেটা আয়না ভবন বা আয়না ঘর নয়। আশার বিষয় যে, এনাগাদ দল বিরোধী শাসক গোষ্ঠী দ্বারা দোর্দন্ড দুর্নীতির এতো ডামাডোল, ধরপাকর, মামলা-মোকদ্দমা সত্ত্বেও ঐ হাওয়া ভবনের তেমন দুর্নীতির ফিরিস্তি শোনা যায় নাই, জানা যায় নাই। জেনেছি, এই হাওয়া ভবনেও প্রবীণ অপেক্ষা নবীনের আধিক্য বেশি ছিল।
ফরাসী বিপ্লব, অক্টোবর বিপ্লবের স্টাইল থেকেও ৫ই আগস্ট বিপ্লবের Advanceness এবং Franking স্টাইলে বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর সমগ্র বাংলাদেশে মতলববাজিতে তান্ডবলীলা চলল। শিক্ষার্থীদের সাথে এযুগে জন্ম নেওয়া কিশোর গ্যাং, টোকাই তাদের যা কাজ তাই করতে থাকল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া প্রবীণ আওয়ামী লীগ এর একটানা দেড় দশক সাকুল্যে দুই যুগের বেশি ক্ষমতায় থাকা, সরকারে থাকা দলটির অনুসারী, হাইব্রিড-অহাইব্রিড, দিল-দরদি, ধান্দাবাজি, সুবিধাভোগী, সুযোগ-সন্ধানী মহলের বহুমুখী সুযোগ সম্প্রসারিত হলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা আওয়ামীলীগ সমর্থক। তাই অপরিণামদর্শী পরিসংখ্যান অজ্ঞ (এই দেড়যুগে সংখ্যালঘুদের/হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা কমেছে) ব্যক্তিরা দেখলো, প্রায় হিন্দুই আওয়ামীলীগ। আওয়ামীলীগ ও হিন্দু এই দুই পরিচয়ের বিপ্লব, প্রতিবিপ্লবকারীরা বেশি দাপট দেখাতে থাকল। দেশের অর্থনীতির চাকা চ্যাপ্টা হয়ে পড়ে গেল। স্বাভাবিক করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সম্মতিতে ছাত্র-ছাত্রীরা নাকাল জনজীবন, স্থবির যানবাহন, রাস্তা-ঘাট ট্রাফিকিং, বাজার নিয়ন্ত্রণ সর্বত্রই স্বেচ্ছাসেবী মানসিকতায় সেবা দিয়ে চলল। সক্ষম, সচেতন জনসাধারণ খাদ্য, পানি, সান্তনা, প্রেরণা দিতে থাকল।
প্রিয় পাঠক, সকল ধর্ম ও ইথিকস্ মতে বয়োজ্যেষ্ঠদের বাস্তব বুদ্ধি বেশি। তাই তাদেরকে সম্মান করার, শ্রদ্ধা করার বাধ্যবাধকতা আছে। ইসলাম ধর্মের উত্তম মানব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর ৪০ বৎসর বয়সকালের পূর্বে তাকে নবুওয়্যাতও দেওয়া হয় নাই তা যেমন সত্য, তেমনি ইসলাম ধর্মে নবীনের প্রতি বহুমুখী গুরুত্বের গল্প আছে। নিজ সংস্থা টিএমএসএস এর কাজে বিভিন্ন জেলায় ভ্রমণকালে দেখেছি, তরুণ-তরুণীরা রাস্তার ডিভাইডার এর আবর্জনা পরিস্কার করছে, দেওয়ালের নোংরা লেখুনীগুলো পরিস্কার করে শিক্ষামূলক লেখুনী, সৌন্দর্যমূলক ছবি আঁকছে। ঝড়, বৃষ্টি, রোদ তাদের কাজ রোধ করতে পারছে না। এগুলো সবই আশা, ভরসা, আনন্দের বিষয়। পরিসংখ্যান পণ্ডিতগণের অভিমতে, এই বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবকালীন কাল জনমিতির লভ্যাংশের কাল। অর্থাৎ Demographic Dividend, মানে যুবকের লাভজনক জাতি। তাইতো এদেশে এদের দ্বারা সবই সম্ভব, যতক্ষণ স্বেচ্ছাসেবী প্রেরণা, চেতনা বেগবান, বুলন্দ (সবল) থাকবে। আমার অশোকা ফাউন্ডেশনের স্কলারশীপভুক্ত পাঁচ বছর প্রশিক্ষণে অনুশীলন-এস্তেমালে যা উপলদ্ধি করেছি তাতে স্বেচ্ছাসেবী চেতনা, প্রেরণা প্রবাহকে স্থায়ী, টেকসই করার জন্য প্রেরণা প্রণোদনা পুরস্কার থাকতে হয়। এজন্য যুব মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারে অথবা স্বেচ্ছাসেবক মন্ত্রণালয় (Volunteer Ministry) নামে পৃথক মন্ত্রণালয় বা পৃথক কমিশন অর্থাৎ বাংলাদেশ জাতীয় ভলান্টিয়ার কমিশন নামক সমৃদ্ধশালী কমিশন করে এই যুব স্বেচ্ছাসেবকগণকে গ্রুমিং করা, মেন্টরিং করা দরকার। বাংলাদেশ জাতীয় স্বেচ্ছাসেবী কমিশনভুক্ত নবীন এবং জনপ্রতিনিধি, আগ্রহী এনজিও জনবল দ্বারা গ্রাম বাংলার আগাছা, খাল-বিল-নদীর কচুরিপানা এবং Kitchen Rotanable Garbage দ্বারা জৈবসার প্রস্তুত করে জমিতে দিয়ে ফসল করলে জমির স্বাস্থ্য ভালো থাকবে, বিদেশ থেকে বৎসরে ২৮ হাজার কোটি টাকার সার আমদানিও করার আবশ্যকতা হবে না। বৈদেশিক মুদ্রা বাচবে, মাটির পুষ্টি স্থায়ীভাবে বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক কমিশন (Bangladesh National Volunteer Commission-BNVC) এই প্রকৃতির সমৃদ্ধ সংস্থা গঠন করে তার মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবক নিবন্ধন, প্রণোদনা (Incentive) প্রদান, কর্মঅর্জন মূল্যায়ন করে শ্রেণীবদ্ধ করা, পুরস্কৃত করা হলে শিক্ষার্থীগণ জাতি গঠনে, সমাজ গঠনে, আইনের শাসন বাস্তবায়নে আদর্শিক অবদান রাখলে অভিজ্ঞ দক্ষ জোয়ান জনগোষ্ঠী দেশ পরিচালনায় যথার্থ ভূমিকা রাখবে। নচেৎ ধারালো অস্ত্র, স্বীয় ভারত্ববিহীন ধারত্ব দ্বারা ইতিবাচক অবস্থান থেকে নেতিবাচক অবস্থানে গেলে বিপত্তি বেশি হবে। সাধু সাবধান!
অধ্যাপিকা ড. হোসনে-আরা বেগম
নির্বাহী পরিচালক, টিএমএসএস, বগুড়া।