কাজী সুমন রাহাত :: বিয়ের রাত, মাস্টারদা এসেছেন বিয়ে করতে। বিয়ের মন্ত্র পড়া হবে, এমন সময় হঠাৎ পাশ থেকে একজন মাস্টারদার হাতে গুঁজে দিল একটু চিরকুট। চিরকুট পড়ে খুবই চিন্তিত ও গম্ভীর হয়ে গেলেন মাস্টারদা। গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ এসেছে কলকাতার দলের উচ্চমহল থেকে। ফুলশয্যার রাতে নির্জন কক্ষে সহধর্মিণী পুস্পকে বললেন, “তোমার কাছে আমার অপরাধের সীমা নেই। তুমি আমার অগ্নি সাক্ষী করা স্ত্রী। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তুমিই আমার স্ত্রী থাকবে। দলের গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমার ডাক এসেছে। আজ’ই তোমার কাছ থেকে আমাকে বিদায় নিতে হবে।” অশ্রুসিক্ত নয়নে মাস্টারদাকে বিদায় দিয়েছিলেন নব বিবাহিতা স্ত্রী পুস্প। শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন মাস্টারদার চিঠি পাবে কিনা। কথা রেখেছিলেন মাস্টারদা। চিঠি আসতো পুস্পর কাছে, খুব গোপনে। সে চিঠি শুরু হতো ‘স্নেহের পুস্প’ দিয়ে আর শেষ হতো ‘তোমার’ই সূর্য’ দিয়ে। আর দেখা হয়নি স্বামী স্ত্রীর? হয়েছিল, পুস্প যখন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত, মৃত্যু পথযাত্রী, সূর্য তখন জেলে। প্যারোলে কয়েক ঘণ্টার জন্য ছাড়া পেয়ে স্নেহের পূস্পকে দেখতে এসেছিলেন মাস্টারদা। কিন্তু তার আগেই জীবন প্রদীপ নিভে গিয়েছিল পুস্পর। “মাস্টার’দা সূর্য সেন” – ডাকনাম কালু। পুরো নাম সূর্য কুমার সেন। যিনি মাস্টার’দা নামেই সমধিক পরিচিত। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা। পূর্ববঙ্গে জন্ম নেওয়া এই বাঙালি বিপ্লবী বীর তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে অংশ নেন এবং নিজ জীবন বলিদান করেন। ১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারি মধ্যরাতে সূর্য সেন ও তার সহযোগী তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসী চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর করা হয়। তাদেরকে ফাঁসি দেয়ার পূর্বে ব্রিটিশরা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে তাদের দাঁত ও আঙুলের নখ অব্দি তুলে নিয়েছিলেন। এবং দেহের প্রতিটা অঙ্গের জয়েন্টে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে ভেঙে দিয়েছিলেন। তারপর নিষ্ঠুরভাবে তাদের অর্ধমৃত দেহ দু’টিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিয়ে উল্লাস করেছিলেন। জেলের কনডেম্ড সেলে সূর্য সেনকে কড়া পাহারায় নির্জন কুঠুরীতে রাখা হত। একজন কয়েদি মেথর সূর্য সেনের লেখা চিঠি ময়লার টুকরিতে নিয়ে জেলের বিভিন্ন ওয়ার্ডে বন্দী বিপ্লবীদের দিয়ে আসতো। মৃত্যুর আগে জেলে আটক বিপ্লবী কালীকিঙ্কর দে’র কাছে সূর্য সেন পেন্সিলে লেখা একটি বার্তা পাঠান। সে বার্তায় তিনি লেখেন “আমার শেষ বাণী- আদর্শ ও একতা”। তিনি স্মরণ করেন তাঁর স্বপ্নের কথা–স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। যার জন্য জীবনভর উৎসাহ ভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মত তিনি ছুটেছেন। তাঁর ভাষায় “ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যে সব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো”। তিনি সংগঠনে বিভেদ না আসার জন্য একান্তভাবে আবেদন করেন। সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের লাশ আত্মীয়দের হাতে হস্তান্তর করা হয়নি এবং হিন্দু সংস্কার অনুযায়ীও পোড়ানো হয়নি। ফাঁসির পর লাশদুটো জেলখানা থেকে ট্রাকে করে চট্টগ্রামের ৪ নম্বর স্টীমার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর মৃতদেহ দুটোকে ব্রিটিশ ক্রুজার “The Renown” এ তুলে নিয়ে লাশের বুকে লোহার টুকরা বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের সংলগ্ন একটা জায়গায় ফেলে দেয়া হয়।ওরা ভেবেছিল বিপ্লব ওখানেই শেষ, কিন্তু না। শোষণের বিরুদ্ধে বিপ্লব চিরকালই চলবে।আজ মাস্টারদার চলে যাবার দিন…লাল সালাম কমরেড। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। ফেসবুক থেকে ।