লেখক- অধ্যাপিকা ডক্টর হোসনে আরা বেগম ।।
স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন ভূখণ্ড, বন-বাদাড়, তরুলতা, পশুপাখি স্বাধীন হয়েছে। মানুষ স্বাধীন হতে গেলে উন্নত মন-মানসিকতা, মানবিকতা, মূল্যবোধ, ঐক্য, সম্প্রীতি যা প্রয়োজন তা ছিল না, নাই। বিশেষ করে স্বাধীন ভূখণ্ডের জনগণই স্বীয় দেশের মালিক হিসেবে বাস্তবায়নের জন্য সক্রিয় সরকার গঠনে গণতন্ত্রের গাড়ির চালক হিসেবে বহুমনা, বহুপন্থী, আদর্শিক রাজনৈতিক দল থাকতে হবে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে স্বাধীনতার অগ্রসৈনিক বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেই সাধারণ মানুষের অনুমান হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির নেতা হওয়া অপেক্ষা আওয়ামী লীগের নেতা হওয়া পছন্দ করছিলেন। ফলশ্রুতিতে সে সময়ের রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থাকুঁড়ে রাখার আনজাম হচ্ছিল। মেজর জলিলসহ জাসদ, ন্যাপ নামক বিরোধী, সমালোচক ডান-বাম পার্টি, মানুষকে অবলীলাক্রমে নিধন চলছিল। তখনই বুঝে ফেলেছিলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির সম্পদ না হয়ে যেন পার্টির সম্পদ হতে যাচ্ছে, তাতে জাতির যাতনা বাড়বে। ২০০৬ সালের পর বিএনপি নামক পার্টি যাকে অনেকেই বলে Basically no party but collection of qualityfull politician, তাই এই পার্টির যৌক্তিক জাতীয় ঐক্য-আদর্শ অর্থাৎ বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ মানে বাঙালি, পাহাড়ি, অবাঙালি যারা বাংলাদেশ নামক টেরিটরিতে বসবাসরত তাদের সকলকে এক জাতি, এক পরিবার গণ্য করে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ গৃহিত হয়েছে। এ ধরনের আপোষ, ঐক্যের পার্টি বিএনপি এর আপোষহীন নেতৃত্বে চালিত বিএনপি সরকার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে ব্যাহত করায় ১/১১ এর আর্মি আশ্রিত সরকার ২ বছর দেশ চালানোর পর যে নির্বাচন দিলেন সেই নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নড়বড়ে (জনতার অনুমান ছিল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবে, বিএনপি বিরোধী দল হবে, কোনো পার্টিই মেজর মেজরিটি পাবে না, কিন্তু আর্মি ব্যাক সরকারের কার্যক্রমকে নিরঙ্কুশভাবে বৈধতা দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগকে বিপুল মেজরিটি দেওয়া হয়েছিল, নির্বাচনে সরকারের হাত ছিল) হলেও মানুষ মেনে নিয়েছিল, জনতা জাগ্রত ছিল। জনতার অপর রূপ জননী। জননীর স্বভাব অন্যায়ের বিপরীতে থাকা, দুর্বলের পক্ষে থাকা।
ওয়ান ইলেভেনের সরকারের হাত থেকে ক্ষমতা গ্রহণকারী আওয়ামী লীগ তাদের ঐ টার্মে জনতা রুষ্ট হওয়ার যা করেছিলেন তা হচ্ছে, কেয়ারটেকার পদ্ধতি দুর্বল করা। তাই ২০১৪ সালের ভোটে জনতার আগ্রহ ছিল না। তদুপরি পার্শ্বের পরাক্রমশালী রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এসে রাজনীতিতে অসম অবদান রাখা শুরু করলেন। এতে জননী নামক জনতাদের অন্তরে আঘাত হলো। এক দেশ এক পার্টি এর খায়েসী ব্যক্তিগণ খোশমেজাজে যা করার তাই করতে থাকলেন। এতে বিশাল বড় বন্ধু ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও তারা আগ্রহ দেখালেন না। ২০১৮ সালে পার্টির অধীনে পার্টির ভোট, দিনের ভোট, রাতের ভোট দল নিরপেক্ষ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যানবিদগণের বিশ্লেষণধর্মী বক্তব্য, প্রতিবেদন ইত্যাদিকে অবজ্ঞা করা হলো। মূলত বিরোধী দলহীন পার্লামেন্টসহ দেশ চলতে থাকল। নেতৃত্বতে দুর্বলতা হলেও শক্তিশালী জনভিতের দল বিএনপি এর দাবি-দাওয়া, ডামাডোল বাজাতে, স্বাধীন মত প্রকাশ করতে, সভা, সমিতি, মিছিল, মিটিং করতে বীরদর্পে বহুমুখী বাঁধা চলল। ভোটের পূর্বে পার্টির কর্তা ব্যক্তি বলতে থাকলেন, শাসক গোষ্ঠীর সাথে দিল্লী আছে, ভারত আছে, আমেরিকার আজাইরা আস্ফালন অদৃশ্য হবে, খেলা হবে, খেলা হবে।
২০২৪ সালের বিপ্লবকে বিচিত্র বলার কারণ, পৃথিবীতে রুশ বিপ্লব, চাইনিজ বিপ্লব, ফরাসী বিপ্লব, ইরানী বিপ্লব সকল বিপ্লবের ক্ষেত্রে বিপ্লবকারীরাই মসনদে বসেছেন, শাসনভার হাতে নিয়েছেন। বাংলাদেশের এই বিপ্লবে সর্বশ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বিপ্লব বিজয়ে তারা মসনদে বসে নাই। দেশের আপামর জনসাধারণের Optimism Oath অর্থাৎ আশার সংকল্পতে কুঠারাঘাত পড়ায় তারা নিরাশার বুদ্ধিবৃত্ত নিয়ে রাজপথে মার্চ টু ঢাকা একদিন আগেই দুই ঘন্টার মধ্যে সর্ব বাহিনীর কারফিউ ভেঙ্গে সুরম্য রাজমহল কব্জায় নিয়ে নিলেও বহুমত, বহুপদ, Heterogeneous মানবগোষ্ঠীর সংস্কার পরিকল্পনার সাম্যতা, সরলতায় দেশ শাসন দুরূহ হবে।
প্রিয় পাঠক, ভারত বাংলাদেশের বন্ধু, কোনো রাজনৈতিক দলের বন্ধু নয়। ক্ষুদ্র বাংলাদেশের বিশাল জনমনের বিপক্ষে ভারতের এরূপ ভাবনা, এরূপ ভূমিকা বাংলাদেশের জনগণকে হতবাক করেছে। আমি ক্ষুদ্র একটি সংস্থা পরিচালনার সুযোগে সমগ্র বাংলাদেশের ২০০০ অফিসে ৫০ হাজার জনবল এবং কোটি ক্লোজ অংশীজন পরিবারের অভিমতে যা জেনেছি, বিপ্লব বছরের জানুয়ারী মাসে যে ভোট হয়েছে তাতে ভোটার উপস্থিতির সংখ্যা ১০% এর বেশি নয়। বাংলাদেশে প্রায় ১০% হিন্দু এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ আছে। তারা সবাই যদি আওয়ামী লীগকে অন্ধ সমর্থন দিতেন তাহলে আওয়ামী লীগের মুসলিম সমর্থকদের ভোট কোথায় গেল? কে পেল? প্রত্যক্ষদর্শীর অভিমতে আওয়ামী লীগের উপকারভোগী মুসলিম ভোটাররাই ভোট কেন্দ্রে গেছে, হিন্দুরা তেমন যায় নাই। তবুও হিন্দু মানে আওয়ামী লীগ এটা ভাবা অলীক, অন্যায়। ভোটের প্রতিযোগিতা ছাড়া মানুষের সমর্থনহীনভাবে দেড় দশক সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের আমলনামা সবার নিকট জানা। যেহেতু মানুষ অধিকার পায় নাই ভোট দেওয়ার, বাক স্বাধীনতার, বিপরীত মত দেওয়ার, সভা-সমাবেশ করার, খাদ্য দ্রব্যের দুর্মূল্য, বিদ্যুৎ বিল কয়েকগুণ বেশি, চলাফেরার ব্যয়-বিধান বেসামাল, বিদেশি জমিতে বিলাসবহুল বাড়ি, ব্যবসা; দেশ শ্মশান। বিস্ময়কর বিপ্লবের যুব সমাজ ভোট পদ্ধতি ব্যাহত করা, বৈষম্য চরমে ওঠা ইত্যাদি বহুমুখী কারণে সংক্ষুব্ধ, বিক্ষুব্ধ। স্বাধীন দেশে পরাধীন নাগরিকতুল্য অনুভব, আবাল, বৃদ্ধা, বণিতা, শিশু-কিশোর, নবীন-যুবক সর্বস্তরের সকলকেই সংক্ষুব্ধ করে তুলেছে। এবিষয়গুলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী অনুমান, অনুভব করতে পারেন নাই, তা তিনি নিজেই বলেছেন। SSF নামক বিশেষ রক্ষা বাহিনী তার জীবন রক্ষার ছলে জনতা এবং জানাজানি থেকে তাকে দূরে রেখেছিল। ফলে সরকার প্রধান জীবনে বাঁচলেও আওয়ামী লীগ সরকার সমূলে মরার উপক্রম হয়েছে। এদেশের বাসিন্দা প্রমাণ করেছে তারা জীবনকে মরণাস্ত্রে পরিণত করে মরতে জানে, চলতে জানে, গড়তে জানে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, মেয়াদী সরকার, নিরপেক্ষ ভোটে আসা সরকার, যিনিই হন না কেন তাদেরকে জনআকাঙ্ক্ষা রপ্ত করতে হবে, নচেৎ কোনো শক্তিই রক্ষা করতে পারবে না। সাধু সাবধান !
অধ্যাপিকা ড. হোসনে-আরা বেগম
নির্বাহী পরিচালক, টিএমএসএস, বগুড়া