Friday, অক্টোবর ১১, ২০২৪

প্রতিবেশি প্রথম

লেখক – অধ্যাপিকা ডক্টর হোসনে আরা বেগম ।।

সকল ধর্ম মতে সমাজ, সভ্যতা, সমবায় ইত্যাদি চেতনায় প্রতিবেশিকে অনেক গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ আছে। আমার ধর্মীয় ওস্তাদের নিকট শুনেছি, তিনি বলতেন, “হাদিসটি সহিহ্ নাকি যঈফ সেটা বলতে পারছি না, রাসুল (সাঃ) বলেছিলেন, খুব শীঘ্রই হয়তোবা একটি আয়াত নাযিল হবে, তাতে সন্তান-সন্ততি, নিকটবর্তী ওয়ারিশ, দূরবর্তী ওয়ারিশ বিবেচনায় মৌরুসের প্রতিবেশিরাও সম্পদের অংশ পাবে।” তাইতো ইসলাম ধর্মমতে ইবাদত সমূহের Impression প্রতিবেশি-সমাজভিত্তিক। যাকাত, কুরবানি, ফেৎরা এগুলোর বিতরণ বলয় প্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজন কেন্দ্রিক গুরুত্ব আছে। হজ্বের ক্ষেত্রেও নিকটতম ওয়ারিশ প্রতিবেশির হককে অসম্পন্ন রেখে হজ্বে যাওয়ার গুরুত্ব নাই। তাই ধার্মিক ব্যক্তিগণ হজ্বে যাওয়ার পূর্বেই নিকটবর্তী, দূরবর্তী ওয়ারিশের দেনা-পাওনা, প্রতিবেশির প্রাপ্য ইত্যাদি সম্পদগত ফয়সালা না করে হজ্বে যান না, যাবেন না। বর্তমানে অন্যায় উপার্জন, ব্যক্তিগত সুদ-ঘুষের ঘনঘটা এবং প্রাচুর্য বেশি হওয়ায় খোদ হবু হাজি সাহেবেরই সম্পদের বৈধতা নাই। তাই আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশির দেনা-পাওনার দরবারে মামুলী ভোজ দিয়ে দোয়া নিয়ে হজ্বে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায় না। এমনকি আপন বোন, বাবার সহোদর বোন-ভাইয়ের প্রাপ্য সম্পত্তি বুঝে না দিয়ে হক্কুল ইবাদ নামক অত্যাবশ্যকীয়, নিবিড় পালনীয় ফরজে আইনের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে হজ্বে যাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। তাই দরবেশ বলতেন,
“হজ্বো ভূমি হয়েছে মক্কা যে কারণ
ত্যাগী দাতা মহাজনে করিয়া ধারণ
তাদের রীতি-নীতি সব করি অবহেলা হজ্বে গিয়ে লাভ শুধু দেখা হবে মেলা। আদেশ পালন তুমি নাহি করো যার
কি লাভে মদিনায়, কবরে তাহার।”
প্রিয় পাঠক, বৈশ্বয়িক পৃথিবীকে Global Village বলা হয়, অর্থাৎ পৃথিবী বিশ্বের একটি গ্রাম, বিভিন্ন দেশ তার পাড়া-মহল্লা। এশিয়া তথা সাউথ এশিয়ার উপমহাদেশীয় দেশগুলোর মধ্যে ভারতবর্ষ একটি মাতব্বর দেশ, অভিভাবক দেশ। বড়দের হক ছোটদের প্রতি সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সেজন্য ছোট বাংলাদেশ ভারতবর্ষের নিকট প্রত্যাশা করার, পাবার হকদার। বাংলাদেশের মানুষ ভারতের নিকট কি প্রত্যাশা করে, কি পেয়েছে, কি পাবে তা ৫-ই আগস্ট বিপ্লবে বরখাস্ত দেশত্যাগী প্রধানমন্ত্রীর মুখেই দেশবাসী নানা সময় শুনেছে। অভিভাবকের উদারতা অপরিসীম হতে হয়। ভারতের সরকারগুলো এই অপরিসীমত্ব দেখাতে না পারলেও ভারসাম্য রক্ষা করে চলতো। ধর্ম নিরপেক্ষ সেক্যুলার গণতান্ত্রিক ভারতে হিন্দুত্ববাদী মুসলিম নিধনকারী মোদী সরকার ক্ষমতা নিয়ে জাতীয় নাগরিক আইন জারি করে কাশ্মীর রাজ্যের বিশেষ ব্যবস্থা বরখাস্ত করার নামে যে সাম্প্রদায়িক সংঘাত উর্বর করার পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, শুধু তাই নয় ভারতবর্ষের চারিপার্শ্বে নেপাল, ভূটান, শ্রীলংকা, আফগানিস্থান, পাকিস্থান, চীন, মালদ্বীপ সবদেশের সরকারই ভারতের দিক থেকে মুখ সরাচ্ছে। প্রত্যেক দেশের সরকারের অবস্থান স্বীয় জাতীয় গণমানুষ, জনতার অবস্থানের আশ্রয় নেয়। আমার অনুমান, মোদী সরকার গ্লোবাল ভারতের (ভারতবর্ষ) বিশাল জনগোষ্ঠীর মন-মানসিকতাকে তোয়াক্কা না করেই চলছে, অথচ মোদী সরকার ক্ষমতা পাওয়ার পর তাদের শপথ অনুষ্ঠানে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্থানসহ সকল প্রতিবেশি দেশের সরকারকে আমন্ত্রণ দিয়ে প্রাণঢালা আপ্যায়ন করে সরকারের যাত্রা শুরু করলে আমরা আশান্বিত হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, ইউরোপে যেমন ঐক্য আছে, সেনজেন ভিসা চলে, এশিয়াতেও তেমনি সার্ক ভিসায় চলাচল করবো, মিল মহব্বতে থাকবো। মিল-মহব্বতে থাকার অন্যতম উপাদান Two way/Multiple way Communication লেনা-দেনা, পক্ষগণের মধ্যে জয়-জয়কার অবস্থা। বাংলাদেশের সাথে ভারত যদি তা করতো, তাহলে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বলতে হতো না, “ভারতকে যা দিয়েছি, ভারত চিরদিন তা মনে রাখবে”। প্রধানমন্ত্রী বলতেন, আওয়ামী লীগ তথা আমার শাসনামলে ভারত থেকে যা পেয়েছি, পাচ্ছি, পাব বাংলাদেশের লোক চিরদিন তা মনে রাখবে, প্রধানমন্ত্রীর মুখে একথা আমরা শুনি নাই। তবুও প্রধানমন্ত্রীর মিতালীর মাত্রা কমে নাই। কারণ, ক্ষমতায় থাকতে গেলে শক্তিধর মাতব্বরকে হাতে, সাথে রাখতে হয়। বাংলাদেশের সংবিধানে লেখা আছে ক্ষমতার উৎস জনগণ, ক্ষমতাই শক্তি। শাসকরা কেন যেন তা ভুলে যান। তাই এই ৫৪ বছরের বাংলাদেশেও ক্ষমতাসীন কয়েকটি স্বল্পকালীন সরকারকে অপ্রত্যাশিতভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়েছে। ভারতের প্রতি ভরসাবান দীর্ঘকালীন আওয়ামীলীগ সরকারকে বিপ্লবের মাথায় বিপদের মুখে অর্ধসহস্র মানুষের আত্মহুতি। আবাল, বণিতা, বৃদ্ধা, নবীন, প্রবীণদের নজিরবিহীন সংগ্রাম, বিপ্লবের মুখে ক্ষমতা ত্যাগ করা, দেশ ত্যাগ করা, দেশ ত্যাগ করার নতুন নজির সৃষ্টি হলো। এক সময়ে টিএমএসএস এর পরামর্শক, সাবেক আমলা ড. শাহজাহান কবিরের সঙ্গে সেতু ভবনে গিয়ে সেতু সচিব আনোয়ার স্যারের চেম্বারে চা খেতে খেতে স্যার বললেন, পাকিস্থানের শাসনতন্ত্রের অধীনে শপথ পড়া, থাকা ব্যক্তিরা তাদের আদর্শিক কারণেই পাকিস্থানের উপরে আস্থাবান থেকে ভূমিকা রেখেছিলেন, আমি নিশ্চিত ইনারা হত্যা,ধর্ষণ,অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজের সঙ্গে ছিলেন না। এগুলো রোধ করার জন্যই রাজাকার মার্কা বাহিনী সৃষ্টি করেছিলেন। এই নেতাদেরকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি দেওয়ার পক্ষে আমি না। এই ফাঁসিতে আমরা ফেঁসে যেতে পারি। চা শেষ করে আসার সময় আমি ড. শাহজাহান কবিরকে বললাম, স্যার এই সচিবের কি হবে। ড. শাহজাহান কবির বললেন, দেখেন কি হয়। কিছুদিন পরেই দেখলাম শুভ্র Bearded Man (সাদা দাঁড়িওয়ালা) আনোয়ার স্যার মন্ত্রীপরিষদ সচিব হয়েছেন, ভালো লাগলো। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার-১ শেখ মঞ্জিলা ফারুক এর আপন বড় ভাই শেখ কাইয়ুম, যিনি শেখ হাসিনার নিকটতম ভাই, তিনি একদিন বললেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের নামে নামিদামি পণ্ডিত, পরহেজগার ব্যক্তিদেরকে ফাঁসি দেওয়ার সিদ্ধান্তে আমার চরম দ্বিমত অমান্য করে হাসিনা তাদেরকে ফাঁসি দেওয়াই আমি মূলত সরকার থেকে দূরে আছি।
হাওয়া ভবনের বহুমুখী সমালোচনাকারী, বিচারকারী, দীর্ঘমেয়াদী সরকারের শাসনামলে আয়না ঘর নামক জঘন্য ঘরের প্রবর্তক, মানবতাবিরোধী অপরাধের ধারক-বাহক, দুর্নীতি-দুঃশাসনে জনজীবন ওষ্ঠাগত, মুষ্টিমেয় Opportunate মহল ছাড়া সবার প্রতি সরকারের আস্থা শূন্যের কোঠায় যাওয়ার অন্যতম কারণ, সরকার নাগরিকদের প্রতি সহায়ক নয়, সরকার আক্রমণাত্মক। নাগরিককে দুমড়ে-মুচড়ে ধরার জন্য খড়গহস্ত। স্বাধীন দেশের নাগরিকগণ মন খুলে-প্রাণ খুলে সরকারকে সহায়ক গণ্য করবে, সরকারের প্রতি আস্থা রাখবে। নাগরিক কেন ভুল করছে সরকার তা দরদি মনে মানবিকতার সঙ্গে মূল কারণ (Root Cause) অনুসন্ধান করবে। তৎপর, অনেক ভেবেচিন্তে প্রয়োজনে Penalty, Punishment দিবে। দীর্ঘমেয়াদী বাংলাদেশি সরকার পরদেশী সরকারের মতো (উপনিবেশবাদ) নাগরিকের অপরাধকে আনন্দ-আহ্লাদ, উপার্জন করার ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করেছে। তাই সরকারের অনুকম্পাযুক্ত ঠুনকো দাবির দাবানলে বিপ্লব ঘটে গেল।
দুঃখের বিষয় যে, আমরা ইতিহাস পড়লেও ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি না। এই সেদিন তিউনিসিয়াতে রাস্তার ফল বিক্রেতা তার জীবনযাত্রার সামান্য কষ্টে নিজের গায়ে আগুন ধরে দেওয়াই এই ক্ষুদ্র অগ্নিস্ফুলিঙ্গতে তিউনিসিয়ার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলো, আরব স্প্রীং সংগঠিত হলো। ব্রিটিশ আমলে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দল, পোড় খাওয়া নেতা-নেত্রী জনতা নামে যাদের এতো জাঁকজমক, তারা কেন আয়না ঘর করলেন, মানুষের মন বুঝলেন না, মাটির গন্ধ পেলেন না, দেশের মধ্যে কি ঘটছে-হচ্ছে জানলেন না, পক্ষের তরুণদেরকেও তার্কিক করে তুললেন। এতে প্রতিবেশি ভারতের বন্ধুত্ব ভূমিকার উদাহরণে অনুপস্থিত থেকে আশ্রয় নেওয়া প্রধানমন্ত্রীর সাথে নিরাপত্তা উপদেষ্টা, বিদেশ মন্ত্রী ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের শলাপরামর্শ, ভারতীয় মিডিয়াদের অহেতুক প্রদর্শন-অতিকথন, এজন্যই তো ছাত্র-জনতা জুডিসিয়ারী অবলম্বনে প্রতিবিপ্লব, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের পটভূমি সৃষ্টি করতঃ দাঙ্গা সৃষ্টি করে প্রতিবিপ্লব, মিডিয়া ক্যু করে প্রতিবিপ্লব ইত্যাদি ইস্যুতে অস্থির হচ্ছেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সহায়ক কথা শান্তির বানীতে শিউরিয়ে উঠছেন। ভরসার বিষয় যে, নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে গঠিত বিপ্লবী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান, বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্ব, সবসময়ই সরল মনে সোজা কথা সহজ করেই বলেন। একদিন আমার উপস্থিতিতেই একজন ভেটার্ন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ক্ষুদ্রঋণের সুদ ব্যাংক ঋণ অপেক্ষা বেশি নেওয়া হয় কি? ইউনূস স্যার বললেন, বেশি নিতে হয়, তাই নেওয়া হয়। নিবিড় ঘনিষ্ঠ তদারকি, জামানতবিহীন আস্থা/বিশ্বাস নির্ভর ক্ষুদ্রঋণের সঙ্গে স্থায়ী সম্পদের জামানতযুক্ত বড় ঋণের সুদের হার তুলনাকারী বুদ্ধিহীন ব্যক্তিদের কথার ব্যস্ততায় আমি সময় দিতে চাই না। সরকারের বিশাল ব্যয় সম্বলিত অর্থঋণ আদালত, বড় বড় ঋণের সুদ তো দূরে থাকুক, আসলই আদায় করতে পারে না,  Non Performing Loan-NPL অনেক বেশি হয়। এর অন্যতম কারণ নিবিড় তদারকিবিহীন বড় ঋণের সুদের হার যা আছে, ক্ষুদ্রঋণের সুদের তুলনায় ঢেরবেশি। বড় ঋণদাতা ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাগণের বেতন-ভাতাদি ক্ষুদ্রঋণদাতা জনবলগণের বেতন-ভাতাদি অপেক্ষা পাঁচ থেকে দশ গুণ বেশি, মিডিয়া সেখানে নিরব। ঋণ পাওয়া মানুষের অধিকার (Access to Finance is Human Rights)। সাদা, সরল, হাবাগোবা মানুষের হাতেও টাকা গেলে সে চালাক-চতুর হয়ে যায়, তার আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, সামাজিক মর্যাদা বাড়ে। মাইক্রো লেভেলে অর্থায়ন হলে গরিব মানুষ জুতা-স্যান্ডেল কিনবে, আলতা-রং-লিপস্টিক মাখবে। এগুলো প্রস্তুত করার মাঝারী এবং বড় শিল্পকারখানা মেজ এবং মেগা লেভেলে সৃষ্টি হবে, কাস্টমার পাবে, সফল হবে মানি সার্কুলেশন; বাজার পরিক্রমা তৃণমূল থেকে ঊর্ধ্ব চলাচল করবে, বেকারত্ব থাকবে না, ব্যাধি-বেমার থাকবে না,  দারিদ্র্যতা যাদুঘরে যাবে। তৃণমূলের ক্ষুদ্র পর্যায়ে এক দফায় ঋণ দিয়ে ৩০-৪০ দফায় কিস্তি আদায় করার সুবাদে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসা সহায়ক তদারকিতে ব্যবসা শক্তি হিসেবে নিম্নস্তরের মানুষের ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা সুগম না থাকলে ভারসাম্য অর্থনীতি জাতিকে ভারসাম্যহীন করে তুলবে। সাধু সাবধান!

অধ্যাপিকা ড. হোসনে-আরা বেগম
নির্বাহী পরিচালক, টিএমএসএস,
বগুড়া

একই রকম সংবাদ

বিজ্ঞাপনspot_img

সর্বশেষ খবর