লেখক – অধ্যাপিকা ডক্টর হোসনে আরা বেগম ।।
সকল প্রশংসার মালিক, অধিকারী মহান সৃষ্টিকর্তা। তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে যতো যা সৃষ্টি করেছেন, বিশেষ করে লক্ষ কোটি জীব, প্রাণি সৃষ্টি করেছেন, সবগুলোরই সেরা হলো মানুষ। মানুষ থেকেও সেরা প্রাণি ইহজগতে আছে তা এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয় নাই। কোনো ধর্ম, সভ্যতা, সায়েন্স তা বলে নাই। ইসলাম ধর্ম মতে মানুষকে সৃষ্টির সেরা প্রাণি (আশরাফুল মাখলুকাত)-ই শুধু বলা হয় নাই, সকল মানুষকে সমসম্মানিত (ওলাকাদ কাররামনা বনি আদম) হিসেবে ঘোষণা দেওয়া আছে। এক্ষেত্রে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোত্রের কোনো পার্থক্য করা হয় নাই। তাই এক মানুষ আরেক মানুুষের প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধা, ভক্তি-মহব্বত, প্রেম-প্রীতি, খাতির-যত্ন করবে, এগুলো মানবতাবাদী কাজ, উত্তম ইবাদত। আমার বড় ভাই পীর আব্দুর রহমান এর সাথে বগুড়ার মহাস্থানগড় যার প্রাচীন নাম পুণ্ড্রনগর, প্রায় ৮০০ বছর পূর্বে যেখানে আরব রাজ্য থেকে সুলতান বলখি মাহীসওয়ার এসেছিলেন, তাঁর সুবাদে অত্র অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম অনুসারীদের সংখ্যা বেড়েছে, সুফিতত্ত্ববাদ সমৃদ্ধ হয়েছে। সেখানে দরবেশ সৈয়দ আলী নূর, দরবেশ সুফী হাসান আলী, দরবেশ আবু ইউসুফ ইনাদের নিকট শুক্রবারের মাহফিলে যেতাম। হুজুরেরা যখন কোনো ভালো কাজ করার, ইবাদত বন্দেগী করার নেকীর অংক বলতেন অর্থাৎ অমুক আমল করলে ওতোটা নেকী, অমুক আমল করলে এতোটা নেকী ইত্যাদি বলতেন। আমি হুজুরকে জিজ্ঞাসা করতাম, নেকীর একক দেখি নাই, বুঝি না (এক নেকী কতটুকু, কত বড়)। আপনারা হুজুর, নেকীর সংখ্যা, নেকীর অংক বলেন কিন্তু গুণাহ্ এর সংখ্যা, অংক বলেন না কেন? ভাই আব্দুর রহমান পীর সাহেব চুপ থাকার জন্য পিছনে হাত দিয়ে কান মলা দিত। পীর সাহেব বলতেন, “আব্দুর রহমান, ওকে কিছু বলো না, ওর দেমাকী মাথা। ও একটা নেকী কতটুকু, কত বড় জানতে চাচ্ছে। ওতো কুফরী-কালাম বলে নাই”। এই বলে পীর সাহেব চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করে মিনিট খানিক চুপ থেকে মাথা উঁচু করে বললেন “পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীব-জগৎ বিশেষ করে মানুষ, অবকাঠামোর কল্যাণকরণের চিন্তারত অবস্থায় একেকটি নিঃশ্বাসকে একটি নেকী বলতে পারো, এইটাই নেকীর একক।” দরবারে বসে থাকা উচ্চ শিক্ষিত ফজলুর রহমান নামক মাহফিলে নিয়মিত অংশগ্রহণকারী একজন বললেন, “এগুলি করার নিয়ত করলেই নিঃশ্বাসে নেকী হবে, না কাজগুলি করতে হবে।” সুফী সাহেব বললেন, “নিয়তেই নেকী হবে, কাজ করলে অতিরিক্ত নেকী হবে, তার হিসাব আলাদা।”
প্রিয় পাঠক, প্রবন্ধের শিরোনাম দৃষ্টে যা বলতে চাই তা হলো, মানুষই সেরা, মানুষই শক্তিশালী। ২০২৪ সালের ১লা জুলাই থেকে ৫-ই আগস্ট এই মাত্র ৩৬ দিনে প্রায় ১৬ বছরের সুরম্য, স্তরে-স্তরে সাজানো শাসন বিপ্লব করে যারা উল্টে দিলেন তারা পুলিশ নন, র্যাব নন, আর্মি নন, সোয়াদ, দোয়াত কলম কিছুই না, বাংলাদেশের নিরস্ত্র তারুণ্য এবং গণমানুষ। শাসক কাঠামোর সশস্ত্র, শক্তিশালী তাগুতকে কিভাবে তাম্বাতুষ করে দিল, এইটা গণমানুষের শক্তি। এই শক্তিকে ক্ষীপ্রতা (Aggressive) করে তোলার অন্যতম কারণ অযোগ্য, অল্প যোগ্য ব্যক্তিরা কাজ অপেক্ষা তোষামোদি, স্তুতি, তেলবাজি করে পদে থাকা, ওপরে ওঠা। সৃষ্টিকর্তার ঘোষণা মোতাবেক সকল মানুষ, হিন্দু, মুসলমান, ইহুদী, নাসারা সবাই সমসম্মানিত, তা ভুলে গিয়ে বক্তব্যের পূর্বে নামে নামে স্তুতিতে অনেক মেধা ব্যয়, সময় ব্যয়, আসল ইস্যু গৌণ করে, গুরুত্ব না দিয়ে ঊর্ধ্বতনের অনুগ্রহের লোভে তোষামোদি, তেলবাজি, স্তুতিতে রত থাকা, এমনকি পবিত্র পার্লামেন্টেও স্তুতি, তোষামোদিতে মত্ত থাকা। ফলশ্রুতিতে মানবিক উন্নয়ন এবং মানুষ স্বীকৃত সিদ্ধান্তসমূহ আমলে আসে না।দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এই স্তুতি কালচার বন্দনার বয়ান থাকে, বৈষম্য বেগবান হয়।
আমি গবেষণার শিক্ষার্থী হিসেবে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা, আন্তর্জাতিক গবেষক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস রংপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ আবু সাইদ এর গ্রামের বাড়িতে কবর জিয়ারতের নিমিত্তে আগমন, পরিস্থিতি অবলোকন ইত্যাদি পরখ করার জন্য গিয়ে যা দেখলাম, সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সাহচর্য অপেক্ষা সৈন্যদের সাহচর্য বেশি, পুলিশ প্রশাসন ভঙ্গুর। প্রধান উপদেষ্টার আগমন উপলক্ষে ব্যস্ততার মধ্যেই বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক ভোল পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়ে ঐ দিনেও জমি দখল, সম্পদ দখল জব্বরভাবে হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের জন্য বুক উঁচু করা বীর শহীদ আবু সাইদ এর কবর এবং পরিবার দেখার জন্য প্রধান উপদেষ্টার গমন যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি গুরুত্বপূর্ণ লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্দাস্থ দইখাওয়া, গেন্দুকুড়ি বর্ডার অঞ্চলে প্রায় পঞ্চাশ হাজার বাংলাদেশী হিন্দু কেন মুখিয়ে আছেন ভারতে যাওয়ার জন্য। তাদের সমাচার কি, সমস্যা কি, কে কিভাবে কেন এই সমস্যা করছে, এগুলোর একান্ত কঠোর অনুশাসন দরকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান প্রফেসর ড. ইউনুস তিন শূন্যের প্রবর্তক (3 Zero i) Zero Poverty, ii) Zero Corruption, iii) Zero Carbon Emission). তাঁর এই তিন শূন্যের সঙ্গে তোষামোদি, স্তুতি, তেলবাজিতেও জিরো আনতে হবে। কারণ, অযোগ্য-দূষিত-অকর্মণ্য অনেকেই মাত্র এই চার নম্বর জিরো দ্বারা অগ্রগামী হয়, জাতিতে রাগের জন্ম হয়। ৫-ই আগস্ট আগামীতে আসবে না, এই অবস্থার ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষে মানুষে বৈষম্য, এলাকায় এলাকায় বৈষম্য, ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠীতে বৈষম্য, মেধা ও অর্জনের মূল্যায়ন ইত্যাদি আমলে নিলে তোষামোদির তকমা থাকবে না। ত্রুটিযুক্ত সমাজের শাসন ব্যবস্থার সংস্কার, রাষ্ট্রের মেরামত করে রাষ্ট্রকে মানুষের অনাস্থার প্রতিষ্ঠান, অবিশ্বাসের প্রতিষ্ঠান, ব্যাপক মাস্তানী আনজাম এই অবস্থা রহিত না করলে রাষ্ট্রীয় আয়ও বাড়বে না, জনকল্যাণকর রাষ্ট্র গঠন হবে না। সাধু সাবধান!
অধ্যাপিকা ড. হোসনে-আরা বেগম,
নির্বাহী পরিচালক, টিএমএসএস, বগুড়া।