মোঃ কায়ছার আলী
“হে পথিক, বারেক দাঁড়ায়ে, সালাম জানাও, শহিদী আত্মারে”। মুক্তিযুদ্ধোত্তর দিনাজপুর মহারাজা হাইস্কুলের স্মরণকালের ভয়াবহ ট্রাজেডিতে শহীদদের অমর স্মৃতিতে চির স্মরণীয় বরণীয় করে রাখার জন্য চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণের স্মৃতিস্তম্ভের এপিটাফটি হৃদয়ে নাড়া দেয়। পাশেই রয়েছে ১৩৫ জন শহীদদের নামের তালিকা। ফারসি শব্দে “চেহেল” এর অর্থ চল্লিশ এবং গাজী মানে ধর্মযোদ্ধা। দিনাজপুর এর প্রতœতাত্তি¡ক সম্পদগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে চেহেলগাজী মাজার শরিফ। অনুমান করা হয়, মুসলিম অধিকারের প্রাথমিক যুগে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে চল্লিশ জন মুসলিম এ জনপদে এসেছিলেন। তৎকালীন রাজা গোপালের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে যুদ্ধে তাঁরা শহীদ হন। ৬৫০ বছর আগে একটি প্রাচীনতম মসজিদ (বর্তমানে আরও একটি), দুটো পুকুর, চারদিকে গাছপালায় আচ্ছাদিত বিশাল জায়গা জুড়ে মাজারটি অবস্থিত। সেই বধ্যভূমিতেই তাঁদের একসঙ্গে সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মত দিনাজপুরেও রয়েছে এক আনন্দ বেদনার মহাকাব্য। যেখানে মিলেমিশে আছে হৃদয় মথিত শোক এবং প্রতিরোধের দৃঢ় চিত্ত উত্থান, জীবন উৎসর্গ করে জীবন জয় করার আখ্যান। মানুষ, স্থান, কাল, পাত্র এবং আবহাওয়া বদলায়। কিন্তু ইতিহাস বদলায় না। ইতিহাস কালের প্রতিচ্ছবি। যুগ যুগান্তরের স্বাক্ষী ও মানব সভ্যতার আলেখ্য। ইতিহাসের দর্শনেই আমরা অতীতকে প্রত্যক্ষ করি। বর্তমানকে গড়ি এবং ভবিষ্যত নির্মাণ পরিকল্পনা করি। ইতিহাস শিক্ষিতদের উৎকৃষ্ট খোরাক, বুদ্ধিমানদের পথের দিশারী। বিবেকবানরাই ইতিহাস গড়েন। মহান মুক্তিযুদ্ধ আমি দেখিনি, শুনেছি। বঙ্গবন্ধুকে স্বচক্ষে দেখার সৌভার্গ্য হয়নি, তবে জেনেছি। স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনাজপুরের মহান সংগঠক এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচরদের খুব কাছ থেকে দেখেছি। সবচেয়ে বেশি কাছ থেকে দেখেছি মহান স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠকারী আলহাজ্ব অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে। বৃহত্তর দিনাজপুর মুক্তিযুদ্ধের সময় ৬ ও ৭ নং সেক্টরের অধীনে ছিল। প্রতিটি জনপদে কমবেশি যুদ্ধ, গণহত্যা, বধ্যভূমি, শহীদের কবর আজও আছে। সেগুলো আমাদের সোনালী ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং প্রাচীন নিদর্শন। সৌন্দর্য আর ঐতিহ্য এক নয়। ঐতিহ্যের পবিত্রতাকে রক্ষা করা পরবর্তী প্রজন্ম তথা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। যদি কোন জাতি এগুলোকে সুরক্ষা না করে তাহলে তা হবে আত্মহনন প্রবণতা। পঞ্চগড়ের মির্জাপুর গ্রামের পুরাতন দিঘীর পাড়ে নিজেদের খোড়া কবরেই এগারজনকে শহীদ করে পাক সেনারা। ঠাকুরগাঁ জেলার রানীশংকৈল উপজেলার কাঁঠালডাঙ্গী রাস্তা সংলগ্ন খুনিয়া দিঘীর গণকবরগুলো দেখলে গাঁ শিউরে উঠে। এরকম অনেক জানা অজানা ইতিহাস আছে। অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা ও সংগ্রামের পর পলাশীর প্রান্তরে হারানো স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে প্রায় দীর্ঘ দুইশো বছরের ইংরেজ বেনিয়াদের গোলামি থেকে মুক্তি পাওয়ার পর পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সাল থেকেই গণবিক্ষোভ ও গণ আন্দোলন শুরু হয়। পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে রয়েছে শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস। কোটি মানুষের স্বপ্নে, ত্যাগে, বীরত্বে রচিত হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ থেকে রক্তক্ষয়ী অসম যুদ্ধে ২৬৬ দিনে ৩০ লক্ষ তাজা প্রাণ আর দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ের লাল সবুজ পতাকা উর্ড্ডীন হয়। যে কোন বিজয় আনন্দের, সম্মানের এবং গৌরবের। বিজয়ের মহা আনন্দে উজ্জীবিত আত্মহারা মুক্তি পাগল বাঙালী তথা এ দেশবাসী দীর্ঘ নয় মাসের অসহ্য যন্ত্রণা আর ভয়াবহ কষ্টের কথা ভুলতে শুরু করে দৃঢ়প্রত্যয়, আকাঙ্খা ও বাসনা নিয়ে নতুন জীবন গড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। বিজয়ের একুশ দিন পরে মায়াভরা শান্তশিষ্ট দিনাজপুর শহরে ঘটে যায় এক মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক দূর্ঘটনা। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পুঁতে রাখা, ফেলে রাখা এবং ছেড়ে যাওয়া মাইন, গ্রেনেড, গোলাবারুদ এবং বিস্ফোরক দ্রব্যসহ অন্যান্য অস্ত্র সংগ্রহ করা ছিল মহারাজা স্কুলে স্থাপিত ট্রানজিট ক্যাম্পের অন্যতম কাজ। ১৯৭২ সালের ০৬ জানুয়ারি গোলাবারুদ ও মাইন ভর্তি দুটি ট্রাক মহারাজা স্কুল মাঠে প্রবেশ করে। ট্রাক থেকে বাংকারের ১০০ গজ দূরত্বে কমান্ডারের নির্দেশমত বিকেল ৪ টায় কিছু মুক্তিযোদ্ধা হাতে হাত বদলের সময় অসাবধানতা বশত একটি মাইন বিস্ফোরিত হলে সাথে সাথে বাংকারটিসহ স্কুল ভবন মাটি কেঁপে গিয়ে আকাশে উড়ে যায়। সেখানকার মাটি ২০-২৫ ফুট গর্ত হয়ে পুকুর তৈরি হয়ে ভিতর থেকে পানি বের হতে থাকে। তখন প্রায় পড়ন্ত বিকেল, গোধুলি লগ্ন। চারদিকে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, বাঁচার আকুতি, আহত নিহতদের আর্তনাদ, মুমূর্ষুদের কান্নাকাটি আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে এক নরক কুন্ড তৈরি হয়। ১৫-১৬ মাইল দূর থেকে মানুষেরা বিকট শব্দের আওয়াজে আঁতকে উঠে। রক্তের ¯্রােত বয়ে যায়। খন্ড খন্ড দেহাংশ, দলা দলা মাংস, বিচ্ছিন্ন হাত-পা মাথা চারদিকে ভাগাড়ে পরিণত হয়। ছিন্ন ভিন্ন পবিত্র দেহাবশেষ উদ্ধারে হিতৈষী জনগণ লন্ঠন, টর্চলাইট, হ্যাচাক লাইট, গাড়ির টর্চলাইট জ্বালিয়ে রাতভর উদ্ধার তৎপরতা চালায়। ঐ দিন সকালে ৭৮০ জন মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ দুই এক দিনের ছুটিতে বাড়িতে এবং কেউ শহরে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। আনুমানিক ৫০০-৬০০ জন মুক্তিযোদ্ধা ঘটনাস্থলে শহীদ হন। পরিচিতদের লাশ তাঁদের আত্মীয় স্বজনেরা নিয়ে যান। পরের দিন ০৭ই জানুয়ারি ১৯৭২ সালে ১৩৫ জনের পবিত্র দেহাবশেষ একত্রিত করে চেহেলগাড়ী মাজার প্রাঙ্গণে হাজার হাজার মানুষ শোক মিছিল করে গণসমাধি দেয়। যাঁরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে করেছিলেন, বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন যুদ্ধজয়ীরা সেই সূর্যের আলোকরশ্মিতে আলোকিত হতে পারলেন না। কালের পরিক্রমায় সবকিছু হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না। নিহত ১২০ জন ও আহত ৩৪ জন মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে মহারাজা স্কুল প্রাঙ্গণে একটি স্মৃতিফলক আছে। যাঁর পৃষ্টপোষক ছিলেন সাবেক এম.পি.এ মহান মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের পশ্চিমাঞ্চলীয় জোন-০৬ এর চেয়ারম্যান এ্যাড. এম.আব্দুর রহিম। মাননীয় হুইপ, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ইকবালুর রহিম এর ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় বর্তমানে শহীদদের স্মরণে একটি অনিন্দ্যসুন্দর স্মৃতিস্তম্ভ ও জাদুঘর শুভ উদ্বোধনের অপেক্ষার প্রহর গুনছে। যুগে যুগে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য যারা নিজের মূল্যবান জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁরা আল-কোরআনের ভাষ্য মতে অমর। আমরা জীবিতদের পাশাপাশি মৃতদেরও কবরস্থানে গিয়ে সম্মান ও সালাম প্রদর্শন করি। চেহেলগাজী মাজারে ৪০+১৩৫ জনের সমাধির পাশে গেলে শুধু আমি নই আপনিও হ্যালোসিনেশনে পরে যাবেন। হ্যালোসিনেশন মানে অমূলক বা অলীক কিছু দেখা, বিশ্বাস করা, মায়া বা বিভ্রান্তি। তখনি চেতন, অবচেতন মনের দ্ব›েদ্ব গভীর শ্রদ্ধাবোধ ও সালাম জানিয়ে আপনিও বলবেন, “আমরা তোমাদের ভুলিনি, ভুলতে পারি না”।
লেখকঃ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট