Tuesday, ফেব্রুয়ারী ১৮, ২০২৫

আব্বাসউদ্দীন আহমদ: জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

আবদুল্লাহ আল মোহন


১.
যুগস্রষ্টা পল্লীগীতি শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ, পুরো নাম আব্বাসউদ্দীন আহমদ হলেও লোকায়ত বাংলার সঙ্গীতের রাজা, বাঙালির ঘরে ঘরে আব্বাসউদ্দীন হিসেবেই পরিচিত। অবিভক্ত বাংলার এক ধ্রুপদী সঙ্গীত-ব্যক্তিত্ব। আব্বাসউদ্দীন আহমদ ১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, মহান এই শিল্পী ১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। প্রবাদ প্রতিম কণ্ঠশিল্পীর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। বলা হয়ে থাকে, গান গেয়ে তিনি বাংলায় নবজাগরণ আনেন। তাঁর দরদী কণ্ঠে গাওয়া পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি প্রভৃতি গান বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। সঙ্গীতকে তিনি নিজের মাঝে ধারণ করেছিলেন গণ-মানুষের কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে। আজও তাই তাঁর গানের আবেদন নিঃশেষিত হয়নি- কালান্তরেও তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন মানুষের মনে। বাংলা গানের অনেক সংকট ও বিবর্তন সত্ত্বেও সেকালের সামান্য যে-কজন শিল্পীর গান মানুষকে এখনো মুগ্ধ ও প্রাণিত করে আব্বাসউদ্দীন তাঁদেরই একজন। তাঁর গান বাঙালিকে আজও স্মৃতিকাতর করে তোলে- নিয়ে যায় গ্রাম-নদী-প্রান্তরের কাছে। তাঁর অর্জন ও সিদ্ধি অসাধারণ।


২.
আব্বাসউদ্দীন আহমদ (জন্মঃ ২৭ অক্টোবর ১৯০১, মৃত্যুঃ ৩০ ডিসেম্বর ১৯৫৯) ছিলেন বহুমাত্রিক শিল্পী-ব্যক্তিত্ব। উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়ার সুরে তিনি বেদনা-বিরহের প্রাকৃত-আবহ রচনা করেছেন, পূর্ববঙ্গের ভাটিয়ালি-বিচ্ছেদী-মরমি গানের সুরে নির্মাণ করেছেন মন-উদাস করা এক শিল্প-ভুবন, কাব্যগীতির রোম্যান্টিক বিধুরতায় আবিষ্ট করেছেন আধুনিক মনকে, ইসলামি গানের ভেতর দিয়ে ধর্মীয় চেতনায় যুক্ত করেছেন এক ভিন্ন শিল্প-সুরধারাকে। এরই পাশাপাশি তিনি উদ্দীপনামূলক জাগরণী গান গেয়ে স্বদেশপ্রীতি ও সমাজমনস্কতার স্বাক্ষর রেখেছেন। রক্ষণশীল মুসলিম সমপ্রদায়কে সঙ্গীতমুখী করে তোলার পেছনে তাঁর ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ-বিষয়ে কাজী নজরুল ইসলামের পাশাপাশি তাঁর নামও উল্লেখ করতে হয়। ছিলেন নজরুলের গানের ভাণ্ডারি- গেয়েছেন আধুনিক কাব্যগীতি, উদ্দীপনামূলক দেশের গান, ধর্মীয় চেতনার গান। তবে তাঁর প্রতিষ্ঠা ও পরিচিতির মূলে রয়েছে লোকগান- বিশেষ করে ভাওয়াইয়া গান। বাংলার প্রান্তিক উত্তর-জনপদের অজ্ঞাত-অনাদৃত এই আঞ্চলিক গানকে তিনি আপন প্রতিভার বলে পাঙ্ক্তেয় করে তোলেন- শিক্ষিত নাগরিকজনের মনে সৃষ্টি করেন গভীর আবেগ ও আবেদন।আব্বাসউদ্দীনের উদ্দীপনামূলক জাগরণী সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্ব-সমপ্রদায়ের উত্থান-চেতনা, সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি-কামনা, সামাজিক সংস্কার, জনহিতব্রত, স্বদেশপ্রীতি। ইসলামি গানের মতো এই উদ্দীপনা- সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও নজরুলই ছিলেন তাঁর প্রধান সহায়। বিশুদ্ধ উচ্চারণ ভঙ্গি, অনুপম সুরেলা কণ্ঠ, তাল-লয় ও মাত্রাজ্ঞান সমন্বিত হয়ে তাঁর কক্তে পল্লীগীতি এক নতুন ব্যঞ্জনা লাভ করে। সারাজীবন তিনি সঙ্গীত সাধনার পাশাপাশি অল্প-বিস্তর লেখালেখিও করেছেন।


৩.
আব্বাসউদ্দীন আহমদের বাবার নাম জাফর আলি আহমদ। তিনি উকিল ছিলেন। নানাকে নিয়ে স্মৃতিচারণায় তাঁর নাতনী ড. নাশিদ কামাল লিখেছেন,‘পিতা মৌলভী জাফর আলী আহমদের ঘরে জন্মেছিলেন শেখ আব্বাসউদ্দীন আহমদ। মাতা হীরামুন্নেসার কোল আলো করা চাঁদ বরণী পুত্র সন্তান। অপূর্ব সুরেলা কণ্ঠ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ।’ আব্বাসউদ্দীন তুফানগঞ্জ স্কুল থেকে ১৯১৯ সালে প্রবেশিকা পাস করেন। ১৯২১ সালে কুচবিহার কলেজ থেকে পাস করেন আইএ। একই কলেজে বিএ ক্লাসে অধ্যয়ন করলেও পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। এরপর তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৩০ সালে আব্বাসউদ্দীনের গান প্রথম রেকর্ড করে ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ কোম্পানি। পরে মেগাফোন, টুইন, রিগ্যাল ইত্যাদি কোম্পানিও তার বহু গান রেকর্ড করে। গ্রাম-গঞ্জ-শহরের আসর ও জলসায় গান গেয়ে এবং গ্রামোফোনে গান রেকর্ড করে আব্বাসউদ্দীন বাংলার মুসলিম সমাজকে সঙ্গীতানুরাগী করে তোলেন। তিনি ১৯৩১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কলকাতায় বসবাস করেছেন। প্রথমে তিনি রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ডিপিআই অফিসে অস্থায়ী পদে এবং পরে কৃষি দফতরে স্থায়ী পদে কেরানির চাকরি করেন। শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের মন্ত্রিত্বের সময় তিনি ‘রেকর্ডিং এঙ্পার্ট’ হিসেবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ঢাকায় এসে তিনি সরকারের প্রচার দফতরে ‘অতিরিক্ত গান সংগঠক’ হিসেবে চাকরি করেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট রাত ১২টার পর ঢাকা বেতার থেকে প্রথম সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ঢাকায় নতুন করে তাঁর জীবন শুরু হল।


৪.
আব্বাসউদ্দীন আহমদ ছিলেন একজন সহজাত সঙ্গীত শিল্পী। আব্বাসউদ্দীন ছিলেন মূলত স্বশিক্ষিত গায়ক। জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, বিচ্ছেদি, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালাগান ইত্যাদি পল্লীগানের নানা শাখার গান গেয়ে ও সেসব গান রেকর্ড করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি কোনো ওস্তাদের কাছে গানের তালিম গ্রহণ করেননি। ছেলেবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম ঝোঁক। তিনি যখন স্কুলের ছাত্র তখন দেখতেন বাড়ির সামনে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। সে মাঠ থেকে ভেসে আসতো কৃষকের উদাত্ত কণ্ঠের ভাওয়াইয়া গান। সে গান তাঁর কচি মনকে প্রবলভাবে আলোড়িত করতো। কোন ওস্তাদের কাছ থেকে গান শেখার সুযোগ না পেলেও, গ্রাম্য গায়ক ও কৃষকদের গান শুনে তিনি শিখে ফেলতেন। নিজ গ্রামের শিল্পী পাগারু এবং নায়েব আলী টেপুর ভাওয়াইয়া গান ও দোতারার সুর তাঁকে ভাওয়াইয়া গান শিখতে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। প্রকৃতির কাছ থেকেও তিনি সঙ্গীত শিক্ষা লাভ করেন ক্ষণে ক্ষণে। ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘ছোটবেলা থেকেই ওই মোরগের ডাক, শিয়ালের ডাক, ঘুঘুর ডাক, পায়রার ডাক, কোকিল, দোয়েল, বউ কথা কও, পাপিয়ার ডাক শুনে শুনে আমার গলায় সুর বাসা বেধেছিলো। এমনকি স্কুলের যখন ঘণ্টা পড়তো সেই ঘণ্টা শব্দের শেষ সুরটুকু, ঢং-এর ঢংটুকু গলায় তুলে নিতাম।’ কেবল গান গাওয়াই নয়, অদ্ভুত সুর ছিল আব্বাসউদ্দীনের গলায়। যেকোনো গান দু’একবার শুনেই সে সুর আয়ত্ত করতে পারতেন। নিজ প্রচেষ্টা ও সাধনায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে নিখুঁতভাবে গান গাওয়া শেখেন। সরকারি চাকরিতে যোগদানের পরপরই কলকাতায় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করেন। সে সময় কলকাতার গ্রামোফোন কোম্পানি “হিজ মাস্টার্স ভয়েস” থেকে নজরুলের “কোন বিরহীর নয়ন জলে” “স্মরণ পারের ওগো প্রিয়”, শৈলেন রায়ের “আজি শরতের রূপ দীপালি” এবং জীতেন মৈত্র’র “ওগো, প্রিয় নিতি আসি”-এ চারটি গান রেকর্ড করে ভূয়সী প্রশংসা লাভ করেন।


৫.
আব্বাসউদ্দীন আহমদ যখন গায়ক হিসিবে আবির্ভূত হন, সে সময় মুসলমানদের গান গাওয়া ছিল হারাম। আর সে কারণে মুসলমান শিল্পীদের নিজেদের নামের বদলে ছদ্মনামে গাইতে হতো। কিন্তু শিল্পী আব্বাসউদ্দীন তার মুসলিম নাম নিয়েই গান করতেন এবং তাঁর ভিন্ন রকম গায়কী ও সুরেলা কণ্ঠ দিয়ে অসম্ভব প্রতিকূল অবস্থাকে জয় করেছিলেন। পারিবারিক প্রবল চাপকে উপেক্ষা করে গানকে ভালোবেসে যে জীবন বেছে নেন সেই জীবনের কথা তাঁর নাতনী ড. নাশিদ কামাল লিখেছেন, ‘মৌলভী জাফর আলী আহমদ তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তানের এহেন মতিভ্রম পর্যবেক্ষণ করে অত্যন্ত রুষ্ট হন। তিনি তাঁর পুত্রকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করা থেকে বিরত থাকেন। প্রচণ্ড অর্থকষ্টের মধ্যে শুরু হয় আব্বাসউদ্দীন আহমদের শিল্পীজীবন, কোলকাতার জীবন। অদম্য মনোবলের অধিকারী শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ জীবনের এই সন্ধিক্ষণে শিল্পী হওয়ার বাসনায় বিত্তবৈভবের লোভকে পরিহার করেন। পিতার আদেশমতো কুচবিহারে ফিরে গেলে তিনি অজস্র সম্পদের মালিকানা এবং হয়তো অত্যন্ত মসৃণ জীবনযাপন করতে পারতেন। কিন্তু সেই লোভ তাঁকে পরাভূত করেনি। তিনি ঘুমন্ত মুসলমান সমাজকে জাগিয়ে তোলার ভূমিকা নিয়ে কোলকাতার অর্থাভাবক্লিষ্ট সঙ্গীত জীবনকেই বেছে নিলেন। যেন কবির ভাষায়—‘নির্ভাবনার শান্তিকে ছেড়ে অশান্তি বেছে নিলাম।’ আব্বাসউদ্দীন একদিন কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বললেন, আপনি জানেন, কিভাবে কাফের কুফর বলে বাংলার মুসলমান সমাজের কাছে আপনাকে অপাঙক্তেয় করে রাখার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে একদল ধর্মান্ধ। আপনি যদি ইসলামী গান লেখেন তাহলে মুসলমানদের ঘরে ঘরে আবার জেগে উঠবে আপনার জয় গান। এরপর থেকে নজরুলের লেখা ও সুর করা রোজা, নামাজ, হজ্ব, জাকাত, ঈদ, শবেবরাত, ফাতেহা হামদে, এলাহি, নাতে রাসূল ও ইসলামি গজল ধরনের অসংখ্য গানে কণ্ঠ দেন শিল্পী আব্বাসউদ্দীন। তাঁর কণ্ঠে নজরুলের ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’, ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ’, ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’ প্রভৃতি গান শুনে গানের প্রতি মুসলমানদের মাঝে আগ্রহের সৃষ্টি হয়। একইসঙ্গে আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’, ‘তোরষা নদী উথাল পাতাল, কারবা চলে নাও’, ‘প্রেম জানে না রসিক কালাচান’ ইত্যাদি ভাওয়াইয়া গান গ্রামোফোন রেকর্ডে বাঁধা পড়ে, ছড়িয়ে পড়ে দেশের আনাচে-কানাচে দূর-দূরান্তে। তার কণ্ঠের মাদকতা ভাওয়াইয়া গানের ভাব ও সুরকে আরও মোহনীয় করে তোলে। এভাবে সুরের মায়াজালে তৎকালীন মুসলিম সমাজ তো বটে, বাংলার জনমানসের তীব্র জাগরণ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লীকবি জসীমউদ্দীন ও কবি গোলাম মোস্তফার লেখা অনেক গান গেয়েছেন। সেই সূত্রে এই তিন বিখ্যাত কবির সাথে আব্বাসউদ্দীনের বিশেষ সখ্যতাও গড়ে ওঠে। সভাগায়ক হিসেবে আব্বাসউদ্দীন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের সঙ্গী হয়ে অন্তত পাঁচ হাজার সভায় সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এই মানুষটি ছিলেন অত্যন্ত মিশুক এবং দূরদর্শী।


৬.
ভাওয়াইয়া ভাটিয়ালি, জারি, সারি, মুর্শিদী, দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদী প্রভৃতি লোকগীতির প্রবাদপ্রতিম কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ আধুনিক গান, কীর্তন আর রবীন্দ্র-নজরুল-দ্বিজেন্দ্র লাল- সজনীকান্তের গানের যুগে মন মাতানো ও প্রাণ নাচানো সুরে পল্লীগীতি গেয়ে কলকাতার অভিজাত সমাজে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। বিচ্ছিন্ন সভা-সমিতিতে গান গাওয়ার ফলে ভাওয়াইয়া গান শিক্ষিত শ্রেণীর কাছে পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।আব্বাসউদ্দীনকে নিছক একজন গায়ক হিসেবে দেখলে যথোচিত হবে না। তিনি সমসাময়িক আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রামকে ধারণ করেছিলেন। বাংলার মুসলিম মানসের শৈল্পিক উত্তরণে কবিতা ও গান রচনায় কাজী নজরুল ইসলাম, নৃত্যকলায় বুলবুল চৌধুরী এবং চিত্রকলায় জয়নুল আবেদীনের পাশাপাশি গান গেয়ে আব্বাসউদ্দীন একটি অবস্থান তৈরি করেছিলেন বলা যায়।


৭.
বলা হয়ে থাকে গান হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের অন্যতম হাতিয়ার। গান মানুষের মনকে পাল্টায়, করে তোলে উতলা, জাতিকে নিয়ে যায় প্রেরণার জগতে, স্বাধীনতার প্রণোদনায় উদ্বেলিত করে তোলে। আব্বাসউদ্দীনের বেলায় এ কথাটি সত্যে পরিণত হয়েছিল। আব্বাস উদ্দীন যখন গান গাওয়া শুরু করেন তখন বাঙালি মুসলিমসমাজে গানের কদর ছিল কম, পরিসরও ছিল একেবারে ছোট। এমনকি মুসলিম সমাজে তখন গান গাওয়া তো দূরে থাক, শোনাও ছিলো বলতে গেলে হারাম। এই অর্গল ভাঙার দায় বর্তেছিল আব্বাসউদ্দীনের কাঁধে। বলতে গেলে স্বেচ্ছায় তুলে নিয়েছিলেন। আব্বাসউদ্দীন স্মরণে প্রখ্যাত গবেষক অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী লিখেছেন, ‘স্ব-সমপ্রদায়ের কল্যাণকামী হয়েও আব্বাসউদ্দীন ছিলেন পর-সমপ্রদায় সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল। আজন্ম তিনি সমপ্রদায়-সমপ্রীতির পরিবেশেই মানুষ হয়েছেন। তাই যখন হিন্দু-মুসলমান বিরোধ কিংবা দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে, তখন আব্বাস তার বিরুদ্ধে কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন নজরুলের গান :
‘ভারতের দুই নয়ন-তারা হিন্দু-মুসলমান
দেশ-জননীর সমান প্রিয় যুগল সন্তান ॥’
আব্বাস ছিলেন উদার, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তবুদ্ধির মানুষ। তাই মুসলমান ছাত্রসমাজের আমন্ত্রণে ‘মিলাদের সভা’য় যেমন ইসলামি গান পরিবেশন করেছেন সাগ্রহে, তেমনি হিন্দু ছাত্রদের অনুরোধে ‘সরস্বতী পূজার জলসা’য়ও গান গাইতে কখনো কুণ্ঠিত হননি। তিনি ছিলেন একই সঙ্গে বিশুদ্ধ বাঙালি ও নিষ্ঠাবান মুসলমান। তাঁর এই দুই সত্তার বিরোধ বাধেনি কখনো। স্বদেশ-বন্দনার পরিচয় আছে তাঁর কোনো কোনো গানে। জন্মভূমির মহিমা ও সৌন্দর্য উদ্ঘাটিত এইসব গানে। প্রকৃতির স্নিগ্ধ-সরস বর্ণনার ভেতর দিয়ে নতুন উপলব্ধিতে স্বদেশকে আবিষ্কারের প্রয়াস আছে নজরুলের কথায় আব্বাসের কণ্ঠের এই গানে :
‘নমঃ নমঃ নমো বাংলাদেশ মম
চির-মনোরম চির-মধুর
বুকে নিরবধি বহে শত নদী
চরণে জলধির বাজে নূপুর॥’
স্বদেশ-বন্দনার এইসব জাগরণী গান আব্বাসের কণ্ঠে গভীর আবেগ ও মমতায় ধ্বনিত হয়েছে। এ-নিছকই একজন শিল্পীর প্রথামাফিক গতানুগতিক সংগীত পরিবেশন নয়, এর বাণীর মর্মার্থ শিল্পী হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন। স্বদেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও একাত্ম হয়েই আন্তরিক প্রেরণার বশে আব্বাস আসরে-বাসরে এইসব গান গেয়েছেন ও রেকর্ড করেছেন।’


৮.
কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৫৫ সালে ফিলিপাইনের ম্যানিলায় আয়োজিত এশীয় সঙ্গীত সম্মেলনে বাংলা লোকসঙ্গীত সম্পর্কে ভাষণ দেন। সেখান থেকে ফেরার পথে রেঙ্গুনে কয়েকটি সভায় যোগ দেন ও গান গেয়ে শোনান। ১৯৫৬ সালে তিনি জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে আয়োজিত আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত সম্মেলনে যোগ দেন। ১৯৫৭ সালে রেঙ্গুনে প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনেও যোগদান করেন। বাংলা লোকসঙ্গীত সম্পর্কে বিশ্বসভায় প্রদত্ত তাঁর ভাষণ ও তাঁর গান শ্রোতৃমন্ডলীর অকুণ্ঠ প্রশংসা লাভ করে। আব্বাসউদ্দীন জীবনে একটিমাত্র বই লিখে গেছেন। বইটির নাম ‘আমার শিল্পী জীবনের কথা’। ‘আমার শিল্পী জীবনের কথা’য় তিনি তাঁর শিল্পী জীবনের সংগ্রাম, প্রাপ্তি, আনন্দ ও বেদনার কথা বলেছেন। ১৯৬০ সালে সঙ্গীতে অবদানের জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার কর্তৃক মরণোত্তর “প্রাইড অব পারফরমেন্স” পুরস্কার, ১৯৭৯ সালে মরণোত্তর ‘শিল্পকলা একাডেমী’ পুরস্কার এবং ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্র্তৃক মরণোত্তর “স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার”- এ ভূষিত হন। তিনি সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল ও খ্যাতনামা গায়ক মোস্তফা জামান আব্বাসী এবং ফেরদৌসি রহমানের বাবা। ছেলে মুস্তাফা জামান আব্বাসী, মেয়ে ফেরদৌসী রহমান, নাতনীদ্বয় নাশিদ কামাল ও সামিরা আব্বাসী এবং নাশিদ কামালের মেয়ে আরমিন মূসা, আব্বাসউদ্দীনের যোগ্য উত্তরসূরি। আব্বাসউদ্দিন দীর্ঘ জীবন লাভ করেন নি।১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর এই মহান সঙ্গীতশিল্পীর জীবনাবসান ঘটে।


৯.
গবেষক অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী আব্বাসউদ্দীনের প্রতিভার মূল্যায়ন করেছেন এভাবে, ‘সাতচল্লিশের দেশভাগের পর আব্বাসউদ্দীনকে কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসতে হয়। নতুন দেশে-নতুন পরিবেশে তাঁর প্রতিভার পূর্ণবিকাশ ও কদরদানি হতে পেরেছে এমন কথা বলা চলে না। যে সমাজ-যে সমপ্রদায়ের জন্য তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে যোগ্য স্বীকৃতি তিনি পাননি। আব্বাসউদ্দীনের জীবনের এই পর্বান্তরে নানা কারণে তাঁর সুরের ধারা ক্রমশ শুকিয়ে আসে। ঢাকায় গ্রামোফোন কোম্পানি না থাকায় রেকর্ডে তাঁর গান প্রকাশ একরকম প্রায় বন্ধই হয়ে যায়। আর পাশাপাশি সরকারি প্রচারমূলক গান ও পাকিস্তানের কওমি সংগীত পরিবেশন করে তাঁর প্রতিভার অপচয় করতে থাকেন। সর্বোপরি কলকাতায় সংগীতচর্চার যে পরিবেশ, সুযোগ ও সমাদর পেয়েছিলেন তা ঢাকায় কখনো পাননি। কলকাতার বৃহত্তর ও অনুকূল পরিবেশ ছেড়ে আসা তাঁর সঙ্গীতজীবনের জন্যে কোনো ভাবেই শুভ হয়নি। আব্বাসউদ্দীনের ট্র্যাজেডি এই যে, তাঁর মতো ধ্রুপদী-প্রতিভাকে ধারণ করার সাংস্কৃতিক আবহ ছিল না ঢাকায়, পৃষ্ঠপোষকতা ও আনুকূল্যের উন্নত সরকারি রুচিও তৈরি হয়নি। সব থেকে বড় সত্য- ঢাকা হয়ে উঠতে পারেনি কলকাতার যোগ্য বিকল্প। বাংলা গানের ভুবনে আব্বাসউদ্দীনের আবির্ভাবের তাৎপর্য বহুমাত্রিক। তিনি বহমান লোকজীবনের সঙ্গীতধারাকে জনপ্রিয় এবং তাতে প্রাণসঞ্চার করেছেন। প্রাকৃতজনের গানকে নাগরিক-মণ্ডপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মীয় অনুষঙ্গের গান গেয়ে একটি সঙ্গীতবিমুখ গোঁড়া-রক্ষণশীল সমপ্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিতে সক্ষম হয়েছেন। উদ্দীপনামূলক জাগরণী গানের পরিবেশনায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করেছেন সমাজ ও স্বদেশের সপক্ষে। তাই এই প্রেক্ষাপট স্মরণে রাখলে তাঁকে নিছকই একজন সঙ্গীতশিল্পীর বলয়ে আবদ্ধ রাখা যায় না, মাত্র ৫৮ বছরের জীবনে তার অর্জন অনেক বড়- অনেক বেশি। আক্ষরিক অর্থেই তিনি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। সেই নিরিখে সব মিলিয়ে আব্বাসউদ্দীন যথার্থই বিবেচিত হবেন একটি ‘প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে।’ শিল্পী আব্বাসউদ্দীন কী এক জাদুর কাঠির বলে সঙ্গীতকে সাধারণ মানুষের মনের ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। আপামর বাংলার শিক্ষিত-আধা শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষের কণ্ঠে ভর করেছিল তার গাওয়া প্রচুর গান। নানান ভঙ্গি ও ঢঙে সমাজকে, মানুষকে একটি স্থির জায়গা থেকে উদ্বোধনের পথে আহ্বানের ভাষা নির্মাণ করেছিলেন আব্বাসউদ্দীন। কাজেই তাকে কেবল কণ্ঠশিল্পী বললে ভুল হবে, তাকে ভাবতে হবে, মূল্যায়ন করতে হবে সমাজ রূপান্তরের শিল্পী হিসেবে।

(সূত্র: বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, শিশু বিশ্বকোষ, ‘দিনলিপি ও আমার শিল্পীজীবনের কথা’- আব্বাসউদ্দীন আহমদ, সম্পাদনা – মুস্তাফা জামান আব্বাসী, দৈনিক ইত্তেফাকসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, ইন্টারনেট )

আবদুল্লাহ আল মোহন
২৭ অক্টোবর, ২০১৪/২৭ অক্টোবর, ২০১৫/৩০ ডিসেম্বর, ২০১৫/২৭ অক্টোবর, ২০১৬/২৭ অক্টোবর, ২০১৭/৩০ ডিসেম্বর, ২০১৭/ ২৭ অক্টোবর, ২০১৯

একই রকম সংবাদ

বিজ্ঞাপনspot_img

সর্বশেষ খবর