মানবতার এক চিরন্তন প্রতিমূর্তি পাবনার বেড়া উপজেলার নাটিয়াবাড়ির মানুষ ডা. ফজলে রাব্বি ওরফে বাচ্চু ডাক্তার গতরাতে মৃত্যুবরণ করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর সেবার কাছে অগণিত মানুষ ঋণী। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একের পর আসছে শোক বার্তা। এরকমই শোকবার্তা ও স্মৃতিচারণমূলক লেখা নিয়ে এই প্রতিবেদন।
মানবতার এই সেবককে নিয়ে ভাসানটেক সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মোহনের একটি লেখা-
ডা. মো. ফজলে রাব্বি মিয়া, মানবতার মহান একজন মানুষের মুখ। আমাদের পাবনার বেড়া-সুজানগর-সাঁথিয়া অঞ্চলে যিনি গরিবের চিকিৎসক, পরম স্বজন হিসেবে বাচ্চু ডাক্তার নামেই সমধিক পরিচিত। তাঁর অকৃত্রিম জনসেবার কারণে আমার কাছে তিনি অলিখিত উপন্যাসের একজন জীবন্ত কিংবদন্তি নায়ক চরিত্র। মাদার তেরেসার মতই তাঁর মানবসেবাও ভালোবাসার কাছেই কেবল দায়বদ্ধ বলে মনে হয়েছে। মানবতার মহান এই সেবক বাচ্চু ডাক্তার গত রাতে ঢাকায় ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি। তাঁকে নিয়ে আমার পুরোনো লেখাটি নতুন করে পোস্ট করলাম-
গ্রামের নিভৃতকোণে নিরন্তর নিরলসভাবে চিকিৎসক হিসাবে নানাভাবে সেবা দিয়ে গেলেও প্রচারের আলোয় তিনি কখনো পথ চলেননি। ফলে দেশ ও দশের কাছে তিনি অচেনাই রয়ে গেছেন, অজানা দেশসেবক, মানবপ্রেমিক হিসেবেই অজানা থেকে গেছেন। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ গানটি অমর শিল্পী ভুপেন হাজারিকা যেন ডা. মো. ফজলে রাব্বি মিয়ার মতোন আলোকিত মানুষদের জন্যেই গেয়ে ওঠেন। তাঁর প্রতিবেশি বা পাশাপাশি বাড়ি হওয়ার কারণে অনেক উদারতা, মহানুভবতার কাহিনি আমার জানা বলেই সংশয়হীনভাবে বলতে পারি, তিনি আমাদের কালের একজন সত্যিকারের নায়ক। বারবার তাঁর মুখের পানে তাকালেই আমি বিস্মিত হই, হয়ে খেয়াল করি, যেন মহান লেখক ঋষি টলস্টয়ের সামনেই দাঁড়িয়ে আছি আমি। পরম শ্রদ্ধেয় স্বজন, মানবতাবাদী মহান এই সুচিকিৎসকের কথা মনে হলেই, দেখা পেলেই আমার মনের ক্যানভাসে বারবার কেন যেন ‘সপ্তপদী’ উপন্যাসের-সিনেমার অমর মানবপ্রেমিক চিকিৎসক, নায়ক কৃষ্ণেন্দু কিংবা উত্তম কুমারের মুখটিই ভেসে ওঠে, মনে পড়ে। আর তাই আমি খুব তীব্রভাবে অমর কথাশিল্পী তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়কেও অনুভব করি। তিনি বেঁচে থাকলে আমাদের কালের মনে রাখবার মতোন এই মহান মানব প্রেমিক, নির্লোভ সুচিকিৎসক ডা. মো. ফজলে রাব্বি মিয়াকে নিয়ে নিশ্চিতভাবেই আরেকটি অমর কথাকাহিনি রচনা করতেন। কারণ ‘সপ্তপদী’ তো তাঁর দেখা চরিত্রকে কেন্দ্র করেই বিরচিত। ডা. মো. ফজলে রাব্বি মিয়াকে যারা চেনেন, জানেন, তাঁদের সকলেই সংশয়হীনভাবে আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, পাবনার আমার এলাকার দরিদ্রজনের চরম দু:সময়ের একান্ত আপনজন, বন্ধু ডা. মো. ফজলে রাব্বি মিয়া। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই তাঁকে যতই দেখছি, জানছি ততই ভালোবেসে ফেলছি, তাঁকে জানা যেন আমার ফুরায় না। এবারের ঈদের ছুটিতে পাবনার নগরবাড়ির গ্রামের বাড়িতে সবচেয়ে বড় পাওনা ডা. মো. ফজলে রাব্বি মিয়া, যিনি সম্পর্কে আমার ভাই হন, দীর্ঘদিন পর তাঁর একান্ত সান্নিধ্য লাভ। বয়সের কারণে তিনি এখন ঢাকায় তাঁর সন্তানদের সঙ্গে বসবাস করছেন বলে এলাকার দু:স্থজনেরা তাঁর সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাঁর স্মৃতিশক্তিও আর আগের মত সবল নেই। অথচ এই মানুষটিই সময়ে-অসময়ে গ্রামের মেঠোপথে পায়ে হেঁটে-সাইকেল চালিয়ে কিংবা দুর্গম চরাঞ্চলে চষে বেড়িয়েছেন সুচিকিৎসা দিতে। কখনো কোন রোগীর কাছ থেকে চেয়ে ফি নেননি। উল্টো রোগীর জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ-পথ্য-পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করেছেন নিজের টাকায়। কেউ খুশি হয়ে গাছের ফলমূল দিলে তিনি তাও সাধারণত গ্রহণ করতে বিব্রতবোধ করতেন। ডা. মো. ফজলে রাব্বি মিয়ার প্রায় মধ্য যৌবনে শিশু সন্তানদের রেখে স্ত্রী মারা গেলে তিনি আর বিয়ে করেননি।সহস্র প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই যুগপৎভাবে পিতা এবং মাতার মমতায় সন্তানদের মানুষ করেছেন। তাঁর সন্তানদের সকলেই এখন সমাজে, দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। আবার তাঁর বাড়িতে অনেক ছেলেমেয়ে জায়গীর থেকেও স্থানীয় স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দরিদ্র রোগীর অসহায় আত্মীয়-স্বজনকে নিজের আপনজন ভেবে নিজ বাড়িতে, নাটিয়াবাড়ির বাড়িতে স্থান দিয়েছেন। তিনি ব্যক্তিগত লোভ-লালসা-সুখের অসুখে কখনো ভুগেছেন বলে মনে হয়নি। সম্পদের মোহ গরিবের ডাক্তারকে কখনো কাবু করেনি। তাঁর কাছ থেকে শেখার আছে অনেককিছু। আমার মতোন অনেকের কাছেই তিনি কেবল মানবতার পাঠই নয়, সদা অমায়িক হাসিমাখা মুখ, বিনয়, ভদ্রতা, সৌজন্যতা শিক্ষারও একজন অনুকরণীয় মানুষ, রোল মডেল হয়ে ওঠেন তিনি। বর্তমানকালের চিকিৎসকদের সেবা প্রদানের নানান সমালোচনাকালে আমার কেবলই পরম এই প্রিয়জনের মুখটি মনের আকাশে ভেসে ওঠে। আমাদের রাষ্ট্রের উচিত তাঁর মতোন মনে রাখবার মতোন মানুষদের খুঁজে বের করে যথাযথভাবে সম্মানিত করা, বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে ভবিষ্যত প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার ব্যবস্থা করা। জানি না তেমন কারো চোখে আমার এ লেখাটি পড়বে কিনা, তাঁকে সম্মানিত করে আসলে নিজেদেরই গৌরবের অংশীদার করার সুযোগ কেউ নেবেন কি না জানি না। তবুও কবীর সুমনের ভাষা ধার করে উচ্চস্বরে বলতে মন চায়, ‘স্বপ্ন দেখার ইচ্ছে আমার আজো যে গেলো না…’।
বিশিষ্ট সাংবাদিক প্রদীপ চৌধুরী তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন-
কোনো রোগী চিকিৎসা পাচ্ছেন না, তাতে কি? তার জন্য একজন বাচ্চু ডাক্তার আছেন।
সেই রোগীর ওষুধ কেনার টাকা নেই, ডাক্তারের ফি নেই, তাতে কি? তার জন্য একজন বাচ্চু ডাক্তার আছেন।
ওই রোগীর বাড়ি ফেরার ভাড়া নেই, তাতে কি? তার জন্য একজন বাচ্চু ডাক্তার আছেন।
শুধু কি তাই? নিজের মাতৃহীন সন্তানদের জন্য রাখা খাবার অবলীলায় অসংখ্য রোগীর মুখে তুলে দিয়েছেন, রাতদুপুরে সাইকেল নিয়ে ছুটে গেছেন বিচ্ছিন্ন চরে কিংবা আরও কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
আরও সহজে বললে, লাখ লাখ মানুষ তার কাছে স্বাস্থ্যসেবা পেয়েছেন প্রায় বিনামূল্যে। কেউ কখনো তার কাছ থেকে নিরাশ হননি। তার কোনো ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া ছিল না। একটাই লক্ষ্য ছিল, স্বার্থহীনভাবে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো। সেই কাজটি তিনি কয়েক যুগ ধরে করে গেছেন।
সবার প্রিয় সাদামনের মানুষ ডাক্তার ফজলে রাব্বি মিয়া ওরফে বাচ্চু ডাক্তার আজ যাত্রা করলেন মহাকালের পথে। তিনি ‘আছেন’ থেকে পৃথিবীর অমোঘ নিয়মে হয়ে গেলেন ‘ছিলেন’। কিন্তু তিনি কখনো ‘অতীত’ নন, তিনি ‘বর্তমান’ হয়ে আমাদের মাঝে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
কবির ভাষায়, ‘এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।’ সত্যিই আজ আমরা কাঁদছি এই মহামানবের প্রয়াণে। মহান এই মানুষটির প্রতি আজীবনের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। তাঁর আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি।
আয়কর কর্মকর্তা আশরাফ সিদ্দিকী তার ফেসবুক পোস্টে লিখেন-
আমি প্রচুর সাধুসন্তদের গল্প শুনেছি। পড়েছি অনেকের কথা। কিন্তু কাছ থেকে একজনকেই দেখার সুযোগ মিলেছে। সত্যিকারের সাধু, প্রকৃত মানবদরদী। কোন কিছুর আকাঙ্খা তাঁকে কখনো করতে দেখিনি। একেবারেই নির্মোহ থেকে মানুষের উপকার করতেন। এমনকি কেউ তাঁকে ভালো বলুক, এরকম কোন কিছু, প্রশংসা, স্তুতি বাক্য কখনোই তাঁকে টানেনি। তিনি আপনার মনে অন্যদের সেবা দিয়ে যেতেন। খুব ছোটবেলায় দেখতাম একটা লোক সাইকেল নিয়ে দু’চার দশ গ্রাম চষে বেড়াতেন। কারও অসুস্থতার খবর তাঁকে দেওয়া হলে তিনি দীর্ঘ ব্যবহারে জীর্ন হওয়া ফনিক্স সাইকেল নিয়ে রোগীর বাড়িতে হাজির হতেন। আমি তাঁকে কখনো ভিজিট নিতে দেখিনি। যখন আরেকটু বড় হলাম, তিনি সাইকেল চালাতে অসমর্থ হয়েছেন ততদিনে, তাঁর বাড়িতে আমাদের তখন নিয়মিত আড্ডা, আরও স্পষ্ট করে বললে, তাঁর রোগী দেখার ঘরে ( মূল বাড়ির বাইরে কাচারি ঘর মতন) আমরা এক কোনে বসে গল্প করতাম, করিম ভাই তাঁর কম্পাঊন্ডারগিরি করত(তাঁর ছেলে। আসলে আড্ডার আমরা সবাই কমবেশি কম্পাউন্ডারগিরি করতাম।), ফাঁকে ফাঁকে আমাদের আড্ডায় যোগ দিতেন, দেখতাম প্রচুর রোগী কাচারি ঘর ভর্তি হয়ে বাড়ির উঠানে গিজগিজ করছে। সব দরিদ্র মানুষ। তিনি তাদেরকে দেখার পর ওষুধের প্রেসক্রিপশন দিলে, রোগীরা বলত, ওষুধ কেনার টাকা নাই, তখন তাদেরকে তিনি নিজ টাকায় কিনে রাখা ওষুধ থেকে ওষুধ দিতেন, তাঁর কাছে ঐ বিশেষ ওষুধ না থাকলে টাকা দিতেন, তো যাদের ওষুধ দিতেন , ওষুধ পাওয়ার পর তারা বলত, ঘরে খাবার নাই, তাদেরকে ঘর হতে চাল এনে দিতেন। তো এমন ছিল তাঁর সেবার ধরণ। অনেক সময় অনেকে ইচ্ছে করে মিথ্যে বলে তাঁর কাছ থেকে টাকা, চাল এসব নিত। আমরা এ নিয়ে তাঁকে বললে, তিনি শিশুর সরলতায় হাসতেন। তিনি সেই কবেকার এমবিবিএস। ইচ্ছে করলে অনেক উপার্জন করতে পারতেন। আরও বড় ডিগ্রি নিয়ে অনেক বড় ডাক্তার হতে পারতেন। কিন্তু সে পথে তিনি হাটেননি। চেয়েছেন এই কুসংস্কারে পূর্ণ গ্রামগুলোতে আধুনিক চিকিৎসা সেবা দিতে। ঐ যে ছোটবেলায় পরীক্ষায় আসা রচনায় ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য’ রচনায় ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে পোষন করে সেবাব্রত নেওয়ার যেসব কথা লিখতাম, তিনি আমাদের পরীক্ষার খাতায় লেখা ডাক্তারকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। তিনি মানবসেবায় কত উপরে উঠে গিয়েছিলেন যে, একটা বিশ মার্কসের রচনায় তাঁর কিয়দংশ পাওয়া যেত। তাঁর জন্য আসলে একশ’তে একশ পাওয়ার মত রচনা রচনা করলেও মাঝে মাঝে কম মনে হয়। তিনি নাটিয়াবাড়িয়ার বাচ্চু ডাক্তার। যারা চেনার তারা তাঁরা তাঁকে চিনে নিয়েছিলেন নিজ গরজে। যারা না চিনতে চাইতেন, তাদেরকেও তাঁকে চিনতেই হতো তাঁর কর্মগুণে। আজ তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন। নক্ষত্রের অনন্ত যাত্রা । তিনি ওপাড়ে নিশ্চয়ই অনেক ভালো থাকবেন।
চিত্রশিল্পী বিপ্লব দত্ত তার পোস্টে লিখেছেন-
আমাদের রাকসা (বাকসোয়া) গ্রমের সকলের প্রিয় ডা. ফজলে রাব্বি না ফেরার দেশে চলে গেলেন। এলাকায় বাচ্চু ডাক্তার বলেই সুপরিচিত ছিলেন বেশি। মানুষের কল্যাণে নিবেদিত এক মহাপ্রাণ। পরোপকারী, নিরহংকারী, বিনয়ী, অসাম্প্রদায়িক চেতনার একজন সর্বজন প্রিয় মানুষ ছিলেন। তিনি আশির দশকে যমুনা নদী ভাঙ্গনের ফলে নিজ ভিটা ছেড়ে জীবনের শেষ ভাগ পর্যম্ত পাবনা জেলার আমিনপুর থানাধীন জাতসাখিনী ইউনিয়নের রাজনারায়ণপুর গ্রামে পরিবার-পরিজনসহ বসবাস করতেন। এমন ক্ষণজন্মা মহামানবের প্রয়াণে গভীর শোক ও সমবেদনা জানাই।
বিশিষ্ট সাংবাদিক জাকির হোসেন লেখেন– চিকিৎসকের মুখচ্ছবি
চলে গেলেন গরিবের ডাক্তার ফজলে রাব্বী মিয়া। বাচ্চু ডাক্তার নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। পাবনার নগরবাড়ী ঘাট এবং এর আশপাশের এলাকায় ভীষণ জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন তিনি। মঙ্গলবার (২৩ অক্টোবর) গভীর রাতের বেদনা হয়ে তিনি আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন। তার এই চলে যাওয়া একেবারে আকস্মিক নয়। বার্ধক্য তাকে ঘিরে ধরেছিল অনেক দিন আগেই। বেশ কিছুদিন ধরে তার শারীরিক অবস্থা ভালো যাচ্ছিল না। তাই মনকে তৈরি করে নেওয়ার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। তবু শেষ হতে থাকা এবং শেষ হয়ে যাওয়ার মধ্যে কতটাই না তফাত। পরিণত বয়সেই মৃত্যু। তবুও মৃত্যু মানেই গভীর দুঃখবোধ, মৃত্যু মানেই হৃদয়ের গভীরে স্থায়ী শূন্যতা।