এবিসি বার্তা

শুক্রবার ১৪ আশ্বিন ১৪৩০, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩

“মশা মারতে কামান দাগা”

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on email

“মশা মারতে কামান দাগা”

“মশা মারতে কামান দাগা”

“মশা মারতে কামান দাগা”
মো. কায়ছার আলী
“মশা মারতে কামান দাগা”। এই বাগধারাটির অর্থ হচ্ছে সামান্য কাজে বেশি আয়োজন। মশা অতি ক্ষুদ্র প্রাণী, বিড়ালের তুলতুলে লেজের আঘাতেও তাদের প্রাণহানি ঘটে। বাগধারাটি প্রচলনের সময় কামান ছিল সর্বোচ্চ শক্তিশালী অস্ত্র,যার আঘাতে অনেক দূর থেকে শত্রæর ঘাঁটি অতি সহজে গুঁড়িয়ে দেওয়া যেত।বর্তমানে টিকা আবিস্কৃত ইয়োলো ফিভার ১৮ শতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধরা পড়লে তদন্তে প্রমানিত হয় একটি হোটেল থেকে এই জ্বর ছড়িয়েছে। যুদ্ধ ফেরত সেনাদের সেই হোটেলটি কামানের গোলা দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়।সম্ভবত সেই ঘটনা থেকেও শিরোনামের বাক্যটির প্রচলন হয়েছে। আপনি যদি নিজেকে শক্তিশালী ভেবে মশাকে তুচ্ছ বা অবহেলা করে ভাবেন যে,একটি ছোট্ট পতঙ্গের কি এমন ক্ষমতা আছে যারা আমাকে ঠেকাতে পারবে।তবে তাদের সাথে একটা রাত কাটানোর চেষ্টা করুন।আপনি তাদের অত্যাচারে রাতে ঘুমাতে পারবেন না এবং তাদের ডানার গুঞ্জন ,জ্বালাময় কামড় ও সবখানে উপস্থিতি আপনাকে উৎকন্ঠায় ফেলে দিবে। ছোট্ট মশা অত্যন্ত ভয়ংকর, প্রাণঘাতি ও শক্তিশালী কীট পতঙ্গ। পৃথিবীর শুরু থেকেই ৩৫০০ প্রজাতির মশা বীরত্বের সাথে আজও টিকে আছে। মশা কিন্তু অনর্থক সৃষ্টি নয় এবং নগণ্যও নয়। কিছু কীট পতঙ্গ, পাখি মশা খেয়ে এবং মশার ডিম মাছেরা খেয়ে বেঁচে আছে। পৃথিবীতে খাদ্য শৃঙ্খল এবং পরিবেশের ভারসাম্য এভাবেই বজায় আছে। আমাদের দেশেই এ পর্যন্ত ১২৬ প্রজাতির মশা শনাক্ত হয়েছে,তবে রাজধানী ঢাকাতেই আছে ১৪ প্রজাতির। পরিসংখ্যান বলছে ,সবচেয়ে বেশি মানুষ পৃথিবীতে মারা যায় মশার কামড়ে প্রায় ১০ লক্ষ,দ্বিতীয়ত ম্যনুষের হাতে খুন হয় প্রতিবছর প্রায় ৫ লক্ষ আর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সাপ।মশার লাইফ স্টাইল বড্ড বৈচিত্রময় এবং রীতিমত বিস্ময়কর। মশার দাঁত ৪৮ টি, পাখা ৬ টি, পা ৮ টি, চোখ ১০০ টি ,পৃথকভাবে ৩ টি হার্ট এবং ২ টি এন্টেনা আছে। রাতের আঁধারে ৭০ ফুট দূর থেকে শিকার করতে পারে। চেতনা নাশক অংশ দিয়ে তারা মানুষের রক্ত নেওয়ার অংশটুকু অবশ করে ১ টি শুড় দিয়ে রক্ত চুষে নেয়।বিশুদ্ধ ,গরম মানে তাজা রক্ত মশারা খেয়ে থাকে। রক্তের গ্রæপ ম্যাচ না হলে সেই রক্ত তারা গ্রহণ করে না। রক্তের ভালমন্দ বোঝার মহাক্ষমতা তাদের আছে। মশার উড়ার গতিবেগ ঘন্টায় এক থেকে দেড় মাইল এবং মিলনের সময় ৫ মিনিট। প্রতি সেকেন্ডে ৩০০-৬০০ বার তারা ডানা ঝাপটাতে পারে ফলে বিরক্তি বা কুৎসিত শব্দ গুণগুণ শুরু হয়। কেউ কেউ প্যানপ্যানানি বা ঘ্যানঘ্যানানি বলে। পুরুষ মশা ১ সপ্তাহ এবং স্ত্রী মশা ৬-৮ সপ্তাহ পর্যন্ত বাঁচে।পুরুষ মশা কেবলমাত্র গাছের রস এবং ফুলের মধু পান করে। সে সময় ফুলের পরাগায়ণ ঘটে। স্ত্রী মশারাই মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর রক্ত খেয়ে জীবন ধারণ করে। প্রতিবারই ১০০-৩০০ ডিম পাড়ার আগে তাদের প্রচুর পুষ্টির প্রয়োজন হয়। রক্তপানের মাধ্যমেই সেই পুষ্টি পূরণ হয়। রক্ত শোষণ মশার জীবন চক্রেরই অংশ। মশা ২০টির মত রোগ ছড়ায় যেগুলো হল ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, পীতজ্বর (ইয়োলো ফিভার), ফাইলেরিয়া, জিকা ভাইরাস ও জাপানিজ এনকেফালাইটিস ইত্যাদি। মশা নিয়ে গ্রীক লোককথা ‘হাতি ও মশা’ গল্পে দেখা যায় ছোট্ট একটা মশা হাতির শুড়ঁ দিয়ে মগজে ঢুকে তাকে কামড়ে পাগল করে তুলেছিল। ধর্মীয় আলোচনা বা ইতিহাস পাঠে জানতে পারি অতিক্ষুদ্র একটি ল্যাংড়া মশা তৎকালীন বিশ্বে প্রভাবশালী ও প্রতাপশালী বাদশাহ নমরুদের নাকের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করে মাথার মগজে নিয়মিত আঘাত করে তাঁকে নাকানিচুবানি খাওয়ায়।অবশেষে আতংকজনক এই মশার কাছে তাঁর জীবন প্রদীপ চিরতরে নিভে যায়।দুনিয়া কাঁপানো ইতিহাসের সেরা ও সফল সেনানায়ক মহাবীর আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান।দু:সাহসিক নাবিক ভাস্কো দা গামা,নতুন দেশ আবিস্কারক আমেরিগো ভেসপুজি,জগৎবিখ্যাত কবি লর্ড বায়রন,আদি কবি দান্তে, লেখক মাস্ক মুলার ,ডেভিড লিভিংস্টোন, রোমান সম্রাট ৫ম হেনরি ও ৩য় অটোমান সম্রাট সহ অনেক রথি-মহারথি,রাজা-বাদশাহ, খ্যতিমান ধনকুবের মশার কামড় খেয়ে মৃত্যুর হিমশীতল ছায়াতলে চলে গেছেন। রোগতত্ব,রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট সূত্রে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারি এ মৌসুমে যেসব মশা আছে তার ৯৯ শতাংশই নাকি কিউলেক্স মশা। এ মশার দ্বারা রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা কম। বাকি ১ শতাংশ আছে এডিস মশা। এই মশার কামড়েই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ডেঙ্গু জ্বরে রক্তের প্লাটিনেট কমে যায়। ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যাক্তিই জানেন এর ভয়াবহতা। এখন আমাদের দেশে গ্রাম এবং শহর সহ সবখানে ডেঙ্গুর হানা প্রকট আকার ধারণ করেছে।রাজধানী রয়েছে ভয়াবহ ঝুঁকিতে। এই কঠিন পরিস্থিতি সবাইকে চমকে দিয়ে ভাবিয়ে তুলেছে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে ডেঙ্গু মোকাবেলায় সাড়ে ২২ লাখ ডলার সহায়তা দিচ্ছে ইউনিসেফ। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা- অদ্যাবধি ১,১৬,৮৪২ জন, মারা গিয়েছেন- ৫৫৬ জন, মত্যু ঝুঁকি সবকিছুই অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলেছে এবং এই হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ডেঙ্গুর কালো থাবা আগেও ছিল। এডিস মশা যে দেশে ঢুকেছে, সেই দেশ থেকে আর সহজে বের হচ্ছে না। নানাভাবে বংশবৃদ্ধি করেই যাচ্ছে। সুযোগ পেলেই সে রক্তচক্ষু প্রদর্শন করছে। দিনে রাতে যে কোন সময়ই এই মশা কামড়ায়। জনমনে আতঙ্ক এমন ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে,সামান্য জ্বর হলেই ডেঙ্গুর ভীতি কাজ করছে।ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত আমাদেরকে অধিক সচেতন এবং খাদ্য তালিকায় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করতে হবে। সারা শরীর ঢেকে রাখা, ঘরের দরজা জানালায় নেট ব্যবহার করা জরুরী। ঘরের ফুলদানি অব্যবহৃত কৌটায় জমে থাকা স্বচ্ছ পানি ফেলে দিতে হবে যেন এডিস মশার লার্ভা না থাকে। বাড়ির ছাদে বা পাশে বাগান, আশেপাশের ঝোপঝাড়, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম,মাটির পাত্র,ডাবের খোসা,ফুলের টব এবং জমে থাকা বৃষ্টির পানি ইত্যাদিতে এডিস মশা ডিম পেরে যেন বংশবিস্তার করতে না পারে। ডেঙ্গু জ্বর নিশ্চিত হলেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং তরল খাবার বেশি বেশি খেতে হবে। এই রোগ ছোঁয়াচে নয় বা বাতাসে ছড়ায় না।একবার ডেংগু হলে আবারও হতে পারে, কেননা এত চারটি ভিন্ন সেরোটাইপ আছে। কিছু বিভ্রান্তি এবং বেশি বেশি ভীতি পেলেও আমাদের চারপাশ পরিস্কার পরিছন্ন রাখতেই হবে। এডিস মশার বংশবিস্তারের পরিবেশ আমাদের চারপাশেই বিদ্যমান। যে কারও অসতর্কতা বা গাফিলতির কারণে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। মশা সুযোগ সন্ধানী খেলোয়াড় এডিস মশা সে গোল দেওয়ার চেষ্টা করবে আর আপনি তার গোল দেওয়া ঠেকাবেন। খানিকটা হোঁচট খেলেও আশরাফুল মাখলুকাত মানুষ সবশেষে জিতবেই জিতবে।

লেখকঃ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
০১৭১৭-৯৭৭৬৩৪, শধরংধৎফরহধলঢ়ঁৎ@ুধযড়ড়.পড়স

Share on facebook
Share on twitter
Share on whatsapp
Share on email