মোঃ কায়ছার আলী
“আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে”। রুপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের গর্বিত মহীয়সী মা এবং উঁচু মানের কবি কুসুম কুমারী দাশ আজ বেঁচে থাকলে বিনয়ের সাথে, মিনতি ভরে , অনুরোধ সহকারে বলতাম হতদরিদ্র, অদম্য মেধাবী আঁধার ঘরে চাঁদের আলো সোনামানিকেরা আজ কথায় না বড় হয়ে সত্য সত্যই কাজে বড় হয়েছে। তারা অর্ধাহারে অনাহারে খেয়ে না খেয়ে কঠোর পরিশ্রম বা অধ্যবসায়ের মাধ্যমে দারিদ্রতাকে জয় করে পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছে। ইতিমধ্যেই তারা তাদের পরিবার পরিজন, গোত্র, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আত্মীয়- স্বজন , পাড়া প্রতিবেশীদের মাঝে হাসনাহেনা, বকুল, বেলী ও রজনীগন্ধার মত সুগন্ধ বিলিয়ে দিয়েছে। আসল কথা হল “দারিদ্র মানুষের শত্রæ নয়, শত্রæ হল হতাশা”। যে মাটিতে পড়ে যায় সে আবার মাটি ধরেই উপরে উঠে। আজ থেকে প্রায় ১৬ শত বছর পূর্বে বিশেষ করে নারীদের জ্ঞান অর্জন বা লেখাপড়া কি পর্যায়ে ছিল তা ভাবতে গেলে এখনও শরীর শিহরিত হয়। তেমনি এক হৃদয় দোলানো বিজয় গাঁথা – শ্লাঘা, অসাধারণ এক ঘটনা দিয়েই তোমাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার আহŸান জানাচ্ছি। ৪১৫ খ্রিঃ মার্চ মাসের এক বিষন্ন দিনে রোমের আলেকজান্দ্রিয়ার একটা পথ মুখর হয়ে উঠেছিল কতগুলো মানুষরুপী পশুর উল্লাসে- একজন মানুষকে ধ্বংস করে দেবার বিকৃত আনন্দে। এই মানুষটি হলো মানব ইতিহাসের প্রথম উল্লেখযোগ্য নারী গণিতবীদ কিংবদন্তি হাইপেশিয়া। পৃথিবীর বৃহত্তম এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য লাইব্রেরী যা খ্রিঃ পূর্ব ৪৮ সাল থেকে শুরু করে ৬৪২ খ্রিঃ মধ্যে চারটি ভিন্ন ভিন্ন যুদ্ধ ও আক্রমণের দ্বারা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। সেই আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরী, লাইব্রেরীয়ান ও গণিতবীদ থিওনের মেয়ে ছিলেন হাইপেশিয়া, জন্ম গ্রহন করেছিলেন আনুমানিক ৩৫১-৩৭০ খ্রিঃ মাঝে কোন এক সময়। বাবার অনুপ্রেরণায় তীব্র জ্ঞান পিপাসা ও যুক্তিপ্রিয়তা জীবনের ধ্যান জ্ঞান হয়ে উঠেছিল তাঁর, শিক্ষা জীবন কেটেছিল এথেন্স এবং ইতালিতে। তিনি ছিলেন প্যাগান ধর্মের অনুসারী, খুব অল্প বয়সেই তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার প্লেটোনিস্ট স্কুলের প্রধান হয়ে উঠেন গণিত , দর্শন এবং জ্যোতিবির্দ্যায় অসামান্য জ্ঞান ও শিক্ষাদানের ক্ষমতার জন্য তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেন সকল শ্রেনীর শিষ্যদের কাছে, যাদের মাঝে ছিলেন অভিজাত পরিবারের সন্তানেরা। কথিত আছে- অসাধারণ রুপসী এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের কারনে অনেক ছাত্র তাঁর প্রেমে পড়ে গিয়েছিল, যদিও জ্ঞানরাজ্য ছাড়া আর কোন কিছুই চিরকুমারী এই মানুষটির মন টানতে পারে নি। আলেকজান্দ্রিয়ার তৎকালীন গভর্ণর অরেস্তেসহ অনেক প্রভাবশালীর শ্রদ্ধাভাজন হাইপেশিয়া খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেছিলেন এমন এক উত্তাল সময়ে যখন খ্রিষ্টান ও প্যাগানে চলছিল মারামারি, এরই মাঝে একদিন সম্রাট থিওডোসিয়াস ডিক্রি জারি করে খ্রিষ্টান ধর্ম ছাড়া অন্য সব ধর্মের আচার -আচরণ নিষিদ্ধ ঘোষনা করলেন। এমন এক বিপদ সংকুল সময়ে প্যাগান ধর্মাবলম্বী ও জ্ঞান- আহরণে প্রাণ হাইপেশিয়া ধর্মান্ধদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন। অরেস্ত শুভাকাঙ্খিরা হাইপেশিয়াকে বলেছিলেন শিক্ষাদান ও মতামত প্রচার বন্ধ করে চার্চের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে কিন্তু তিনি তো সে ধাতুতে গড়া নন। তখন ধর্র্মান্ধদের চিরাচরিত ঘৃণ্য প্রথা অনুযায়ী আলেকজান্দ্রিয়ার আর্চবিশপ থিওফিলাস রোমান সম্রাট থিওডোসিয়াসের কাছ থেকে সেরাপিয়াম নামক জ্ঞান মন্দিরটি ধ্বংসের অনুমতি আদায় করে নিয়েছিলেন, যা ছিল হাইপেশিয়ার পাঠশালা। আলেকজান্দ্রিয়া জ্ঞান বিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু । যখন মুর্খতার এক হলকায় পুড়ে যাচ্ছিল সেরাপিয়ামের পুস্তকাবলী সেই আগুনের মধ্য থেকে পাগলের মতো দু’হাতে ও বুকে আগলে যে ক’টা পুস্তক পেরেছিলেন রক্ষা করেছিলেন হাইপেশিয়া। থিওফিলাসের মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরী সিরাল ধর্মকে পুঁজি করে যোগাড় করা অনুসারী দলের মনে হাইপেশিয়াকে আক্রমণের লক্ষ্য হিসেবে পরিণত করে। ৪১৫ খ্রিঃ মার্চে প্রকাশ্য দিবালোকে সিরালের একদল অন্ধ অনুসারী রাস্তায় হঠাৎ হাইপেশিয়াকে চুলের মুঠি ধরে রথ থেকে নামিয়ে সহস্র জনতার মধ্য দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যায় উপাসনালয়ে। উদ্ধত এই নারীর উচিত শিক্ষা হতে দেখে উচ্ছ¡সিত হয় তাঁর কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত ও ধর্মান্ধ একদল পশু আর অক্ষম আক্রোশে গাল বেয়ে অশ্র“ত নামে তাঁর শিষ্যদের। হাইপেশিয়াকে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়, পোশাক টেনে ছিঁড়ে বিবস্ত্র করে ফেলা হয়। অপমানে কম্পমান তাঁর শরীরে সমস্ত চামড়া তুলে ফেলা হয় ধারালো পাথর দিয়ে ঘষে ঘষে। যন্ত্রনায় কাতর হাইপেশিয়ার আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে আলেকজান্দ্রিয়ার বাতাস। এখানেই শেষ নয় হিংস্র ধর্মান্ধরা হায়েনার মত চারপাশ থেকে টেনে খন্ডবিখন্ড করে ফেলে তাঁর সমস্ত শরীর। ততক্ষণে আলেকজান্দ্রিয়ার আলো নিভে গিয়ে মধ্যযুগীয় আঁধার শুরু হয়ে গিয়েছিল, তবু সে আঁধার আরো গাঢ় করতে হাইপেশিয়ার খন্ডিত দেহ পুড়িয়ে ছাই করে আলেকজান্দ্রিয়ার আকাশে- বাতাসে ছড়িয়ে দেওয়া হল সেই দেহভস্ম -চার্চের সাথে তাও আবার সামান্য নারী হয়ে বিরোধে যাবার পরিণতি জানিয়ে দিতে। এরপর বহুদিন কেউ বলেনি হাইপেশিয়ার কথা, ১৯ শতক থেকে আবার শুরু হয় তাঁর গাঁথা বর্ণনা, তবু আজও অনেকেই জানেনি এই গণিতবিদ, জ্যোর্তিবিদ, ও দার্শনিকের কথা, যিনি নারীত্বের সীমা পেরিয়ে আলোকিত মানুষ হতে পেরেছিলেন। তোমাদের কাছে আজ আমার প্রশ্ন- “এ রকম পরিবেশ কি দেশের কোথাও আছে?” নেই বলেই তো তোমরা ভাগ্যবান। বর্তমান যুগে আমাদের মানসিকতার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। আজ তোমাদেরকে কিংবদন্তি বা আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তোমাদের পাশে বন্ধুর মত এগিয়ে এসেছে বা ছায়ার মত দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন ব্যাংক , এনজিও সহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন ব্র্যাক , গ্রামীণ ব্যাংক , এক্সিম ব্যাংক, ডাচ বাংলা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া এবং ইসলামী ব্যাংক।। মহামতি বুদ্ধ বলেছেন “দুর্ভাবনা থেকে দুষ্কর্ম , দুষ্কর্ম থেকে দুর্ভোগ” এ রকম বিব্রত অবস্থায় তোমাদের যেন পড়তে না হয়, তাই তো তোমাদের উচ্চশিক্ষার ব্যয় ভার বহন করার জন্য আর্থিক ও স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে বৃত্তি প্রদানে দরখাস্ত আহŸান করছে। ব্যক্তিগত ভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উদার এবং মহানুভব ব্যক্তি বৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন। দিনাজপুর জিলা স্কুলে আমেরিকা প্রবাসী আলোকিত মানুষ ডাঃ সামসুল আলম স্কলারশীপ -২০১১ নামে তিনি নিজেই দশ লক্ষ টাকা দিয়ে চালু করেছেন। দেশ ও জাতির বিবেক সাংবাদিক ভাইয়েরা তাদের লেখনির মাধ্যমে অদম্য মেধাবীদের জীবনীগুলো তাদের নিজ নিজ পত্রিকায় প্রকাশ করছেন। কবি কালিদাস বলেছিলেন , একা শকুন্তলা, শকুন্তলা নাটকের এক-তৃতীয়াংশ । ঠিক তেমনি জ্ঞানের ভান্ডার সংবাদপত্র বা সাংবাদিক ভাইয়েরা আঁধার ঘরে চাঁদের আলোদের আলোকিত মানুষ গড়ার ক্ষেত্রে এক-তৃতীয়াংশ। পরিশেষে বেগম সুফিয়া কামাল রচিত আজিকার শিশু কবিতার দু লাইন লিখে তোমাদের অভিনন্দন জানিয়ে এবং আলোকিত মানুষ হওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে শেষ করছি। “ তোমরা আনিবে ফুল ও ফসল পাখি ডাকা রাঙা ভোর, জগৎ করিবে মধুময় প্রাণে প্রাণে বাঁধি প্রীতি ডোর”।
লেখকঃ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
০১৭১৭-৯৭৭৬৩৪,