Tuesday, ডিসেম্বর ১২, ২০২৩

তরুণ বিজ্ঞানী বন্ধু অঞ্জনের মৃত্যু : এক প্রকৃত নক্ষত্রের ঝরে পড়া

তরুণ বিজ্ঞানী বন্ধু অঞ্জনের মৃত্যু : এক প্রকৃত নক্ষত্রের ঝরে পড়া

আলমগীর খান

মৃত্যুসংবাদ আমাকে তেমন কাতর করে না, এমনকি অনেক রক্তসম্পর্কীয় মানুষের মৃত্যুও। কিন্তু প্রকৃত বন্ধু ও বন্ধুপ্রতিম কোনো কোনো মানুষের মৃত্যু এই আমিও মেনে নিতে পারি না, খুব কষ্ট হয়। তেমন একটি মৃত্যুই হলো আজ সকালে; লেখক, বিজ্ঞান-সাধক ও উদ্ভাবক আনোয়ারুল আজিম খান অঞ্জনের মৃত্যু নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে। স্ট্রোক করেছিলেন গত ৮ মে, তারপর মুগদা জেনারেল হাসপাতাল থেকে নিউরো সায়েন্সে অচেতন অবস্থায়।
অঞ্জন ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ৪/৫ বছরের হতে পারে, পাবনার কাশিনাথপুরের সাংস্কৃতিক সংগঠক, কবি-গীতিকার, সাংবাদিক ও লেখক আলাউল হোসেনের মাধ্যমে। সেখানকার কাশিনাথপুর বিজ্ঞান স্কুলে পড়াতেন। ছিলেন একজন মেধাবী প্রকৌশলী, ফেলে দেয়া কাঠের গুঁড়া থেকে একটি বিকল্প জ্বালানির উদ্ভাবক। সেইসঙ্গে সমাজসচেতন, দেশপ্রেমিক, মানবতাবাদী, সৎ, বন্ধুবৎসল, উন্নত রুচিজ্ঞানসম্পন্ন এক মহান মানুষ। আমার সঙ্গে তাঁর দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে কম, কিন্তু মাঝেমাঝে ফোনে কথা হত। একসঙ্গে কেটেছে একদিন প্রায় সারাদিন যখন ফেব্রুয়ারির শেষে ঢাকা থেকে নাটিয়াবাড়ির কাছে তাঁর গ্রামের বাড়ি গেলাম তাঁর স্থাপিত বিকল্প জ্বালানির বন্ধ কারখানাটি দেখতে। বাসে ও লঞ্চে সারাক্ষণই কথা বলতে বলতে গেছি। সর্বশেষ কথা হয়েছে এই ঈদের পর ৪ তারিখ। ৮ তারিখ যখন মুগদা হাসপাতালে তাকে দেখতে গেছি তখন তিনি অচেতন।
অঞ্জন ছিলেন একজন শক্তিশালী লেখক। কিন্তু ব্যবসায় অনেক টাকা ক্ষতির পর ও একটি ভালো চাকরির অভাবে আর্থিক দুশ্চিন্তায় লেখায় মন দিতে পারতেন না। বেগম রোকেয়ার ওপর কিছুদিন আগে তাকে লিখতে বলেছিলাম; লেখায় মন দিতে না পারার কারণগুলো বললেন।
২০১৮ এর ৩ মে কাশিনাথপুর বিজ্ঞান স্কুল আয়োজিত ‘শিক্ষাক্ষেত্রে ছেলেরা কেন মেয়েদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে শীর্ষক একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে আমি একজন আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলাম, অঞ্জন ভাই সঞ্চালন করেছিলেন। মোটামুটি সেসময়ের কিছু আগে থেকে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। এরপর আন্তরিকতা বাড়ে। শিক্ষালোকের অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৮’র সংখ্যায় কাশিনাথপুরের রিক্সাওয়ালা ময়ছেরের সততা নিয়ে তাঁর একটি লেখা প্রকাশিত হয়। শিক্ষালোকের জানুয়ারি-এপ্রিল ২০১৯ সংখায় বিজ্ঞানী নজরুল ইসলামের যে লেখাটি লেখেন তা মুগ্ধ হয়ে পড়বার মত; লেখাটি খুব প্রশংসিত হয়। যা পরে আমার সম্পাদিত ‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি’ সাময়িকীর ১ম সংখ্যায় ২০২০ এর ফেব্রুয়ারি পুনঃপ্রকাশিত হয়। শিক্ষালোকের মে-জুন সংখ্যায় ২০১৯ এর সংখ্যায় তিনি তাঁর উদ্ভাবিত বিকল্প জ্বালানি সম্পর্কে লেখেন। ২০১৯ এর ৬ নভেম্বর নাটিয়াবাড়ি স্কুলে ‘আমাদের শিক্ষা: বিচিত্র ভাবনা’ বইটির ওপর শিক্ষালোক আয়োজিত একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি আলোচনা করেন। শিক্ষালোকের অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০২১ সংখ্যায় তাঁর লেখা ‘আমাদের বিজ্ঞানচর্চা’ প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞান-জগতের মজার মজার ভুল নিয়ে তাঁর আরেকটি লেখা ‘ভুলের ভয় কী?’ ‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি’র ২য় সংখ্যায় ২০২১ এর ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয়। দুয়েকদিনের মধ্যে প্রকাশিতব্য সংখ্যাটিতেও আছে তাঁর আরেকটি লেখা।
সর্বশেষ তাঁর সঙ্গে সবচেয়ে আনন্দদায়ক সময় কাটে সিদীপ অফিসে ১ এপ্রিল ২০২২ ৪র্থ শিক্ষালোক লেখক-শিল্পী সম্মিলনে। এখানে তাঁর একটি উপস্থাপনা ছিলো- বায়োম্যাস ফুয়েল: উচ্ছিষ্ট বস্তু থেকে তৈরি জ্বালানি। এটি ছিল এই সম্মিলনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় উপস্থাপনা যা বহুল আলোচিত ও উপস্থিত অনেকের আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়। অনেকেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন তাঁর উদ্ভাবিত এ প্রযুক্তি সম্পর্কে।
আমার এ মহান বন্ধুটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন তাঁর চারপাশের মানুষ ও প্রচলিত সমাজ তাঁকে ধারণ করার ক্ষমতা রাখেনি, তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে পারেনি তাই। এ তরুণ বিজ্ঞানীর অসময়ে এমন মৃত্যুর জন্য এ সমাজ দায়ী। তিনি এ সমাজের ও রাষ্ট্রের অবহেলার শিকার। ক্ষতিগ্রস্ত দেশ, জাতি ও মানবতা। অঞ্জন আমার মনের অঞ্জন হয়ে চির অটুট থাকবেন। এ দুদিনের জগতে ভালো ছিলেন না, চিরদিনের জগতে ভালো থাকুন- এই প্রার্থনা।

আলমগীর খান : নির্বাহী সম্পাদক, শিক্ষালোক।

একই রকম সংবাদ

বিজ্ঞাপনspot_img

সর্বশেষ খবর