আলাউল:: ৩-৪ দিন পূর্বে আমার এক স্কুল শিক্ষক বন্ধু কথা প্রসঙ্গে বলছিলো- ইদানিং কোন দাওয়াতপত্র হাতে এলেই আগে দেখি কোথাও বি.দ্র. লেখা আছে কি না। আমি জিজ্ঞেস করলাম- কেমন? সে বললো- কেউ কেউ দাওয়াতপত্রে উল্লেখ করেন- উপহার নয়, দোয়াই কাম্য। এ রকম চিঠি হলে দাওয়াতে যাই। এক সময় সব দাওয়াতেই যেতাম। এখন আর যাওয়া সম্ভব হয় না। দুর্মূল্যের বাজারে ১৬০০০/- টাকা বেতনে পরিবার-পরিজন নিয়ে চলাই কঠিন। তারপরে যদি মাসে দুইএকজন করে শিক্ষার্থীর সুন্নতে খাৎনা বা জন্মদিনের দাওয়াত পাই- কিভাবে মেইনটেইন করবো? সঙ্গে গরীব আত্মীয়-স্বজনকেও দেখতে হয়। শিক্ষক হিসেবে দাওয়াতে গেলে দুই হাজার টাকার নিচে দেয়া যায় না।
একবার কি ভেবে দেখেছেন- আমার ওই বন্ধুর আকুতিভরা কথাগুলো কিন্তু আমাদের মত স্বল্পআয়ের সব মানুষের মনের কথা। জগ-কলস-প্লেট-গ্লাস সেট কিংবা ঘড়ি দিয়েও বড় বড় দাওয়াত খেতে দেখেছি একসময়। এখন যুগের পরিবর্তনে দাওয়াতের ধরনেরও পরিবর্তন হয়েছে। রীতিমতো হালখাতার দৃশ্য!
আয়োজকরা টাকা আদায়ের জন্য টালি খাতা তৈরি করে টেবিল-চেয়ার দিয়ে দুইচারজনকে বাড়ির প্রবেশ পথেই বসিয়ে রাখেন৷ সরাসরি না বললেও পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দেন- আগে পেইড, পরে খেতে বসেন! হালখাতাসদৃশ এরকম বিয়ে-জন্মদিন-খাৎনার দাওয়াতে আমাকেও প্রতি মাসে অংশ নিতে হয়। কোন মাসে একটি, কোন মাসে দুইটি আবার কোন কোন মাসে চারপাঁচটিও। দাওয়াতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় তিন-চার বছর আগে সিদ্ধান্ত নিলাম- শিক্ষার্থীদের বাসায় যে কোন দাওয়াতে গেলে এখন থেকে আর নগদ অর্থ দেবো না। বরং শিশু-কিশোর উপযোগী কিছু বই উপহার দেব। নগদ টাকা দিলে অভিভাবকদের পকেটে যাবে, থালা-বাসন কিনে দিলেও বিক্রি করে খাবে। আর যদি বই দিই তাহলে ওই শিক্ষার্থীর সংগ্রহে থাকবে, কাজেও লাগবে। এজন্য বাংলা বাজার থেকে কিছু বই কিনে এনেও রেখেছি। এতে আমার জন্য সুবিধা- পাঁচশ’ টাকা মূল্যমানের ৫ টি বই প্যাকেট করে দিতে পারি। নগদ অর্থ দিলে তো ১০০০-১৫০০ এর নিচে দেয়া যায় না।
এভাবে ১০-১৫ টি দাওয়াত খাওয়ার পরে গোপন সূত্রে খবর পেলাম, দুইচার জন অভিভাবক আমাকে ছোটলোক বলেছেন। কথাটি শুনে আমার একটুও খারাপ লাগেনি। বরং এখনও সে ধারাই অব্যাহত রেখেছি; এতে যদি দাওয়াতপত্র পাওয়া চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় তো যাক। হালখাতার মত টালিখাতা খুলে বাড়ির ফটকের সামনে চেয়ার-টেবিলে বসে দাওয়াত খাওয়ানোর নামে অর্থ সংগ্রহ করার নাম নিশ্চয়ই বড়লোকি নয়? মানুষকে যদি এক বেলা খাওয়াতেই ইচ্ছে জাগে, তবে ফ্রীতে খাওয়ান না…
এ বিষয়ে গতবারের এক মজার ঘটনা মনে পড়ে গেল। আমার বিশেষ পরিচিত এক ব্যক্তির ছেলের সুন্নতে খাৎনার অনুষ্ঠানে দাওয়াত পাই। কিন্তু অনুষ্ঠানের দিন দুপুরে শুরু হওয়া প্রকাণ্ড ঝড়ের কারণে বাসা থেকে বের হতে পারিনি। দুই দিন পরে জানতে পারলাম- পাঁচ শতাধিক দাওয়াতির মধ্যে মাত্র দেড়শ’ জন উপস্থিত হয়েছিলেন। ভদ্রলোক চরম আক্ষেপ করে বলছিলেন, ভাই, ঝড়ের কারণে আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। নগদ যা ছিল, তার সাথে সমিতি থেকে এক লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। কিন্তু বিধি বাম! ভিআইপি কোন গেস্ট আসতে পারেননি।
তার কথা শুনে আমিও তাকে আশ্বস্ত করতে বলেছিলাম, ভাই আপনি যদি দাওয়াতপত্রে উল্লেখ করতেন- আবহাওয়া খারাপ থাকলে পরের দিনও অনুষ্ঠান চলবে। তাহলে হয়তো খাবারগুলো গরম করে পরের দিনও দাওয়াতিদের খাওয়াতে পারতেন এবং আপনার খরচ অন্তত উঠে আসতো!
সুত্রঃ ফেসবুক (আলাউল হোসেন, শিক্ষক, কলামিস্ট, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার।)