Tuesday, ডিসেম্বর ১২, ২০২৩

ড. আশরাফ পিন্টুর অন্তরালের মুখোশ

আলাউল হোসেন

বাংলাদেশের সাম্প্রতিককালে গল্প নিয়ে যুগপৎ আশা ও হতাশা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বলা হয় ষাটের পর উজ্জ্বল কোন দশক আমাদের নেই। কিন্তু আমরা জানি, ষাটের দশকের পর নব্বই বা শূন্যের দশক কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অর্থাৎ নব্বই ও শূন্য দশকের গল্পকাররা প্রচলিত গল্প লেখার ছকের বাইরে নতুন ধারায় গল্প লিখেছেন। এদের মধ্যে আশরাফ পিন্টু আলাদা, অন্যতম। কেন আলাদা- তা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। নিভৃতচারী ও প্রচারবিমুখ আশরাফ পিন্টুকে নিয়ে এমনিতে কম লেখা হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, এ সব আলোচনা প্রায়শ ধোঁয়াশায় পরিপূর্ণ এবং ক্ষেত্র বিশেষে নেগেটিভ। আগেই বলেছি আশরাফ পিন্টু আলাদা। আশরাফ পিন্টুর মৌলিকত্ব ও ভিন্ন হওয়ার প্রধান কারণ- অণুগল্প। অণুগল্প সাহিত্যে খুব প্রচল নয়। বনফুল থেকে অণুগল্পের সূচনা হলেও এখন পর্যন্ত ব্যাপকভাবে এর প্রসার ঘটেনি। বনফুলের পর দু’একজন লেখক অণুগল্প লিখলেও স্বাতন্ত্র্যগ্রন্থ হিসেবে এ যাবৎ পর্যন্ত আশরাফ পিন্টু ছাড়া কেউ তা প্রকাশ করেননি।

অণুগল্প সম্পর্কে আমরা একটা সরলীকরণ করতে পারি যে, আমাদের গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের আর্থসামাজিক ও ব্যক্তি জীবনের ক্ষণিক উজ্জ্বল চিত্র অণুগল্পে ধরা পড়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিষয়বস্তু ও রচনাপদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে হয়ে থাকে। আশরাফ পিন্টু প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে শুধুমাত্র গভীর জীবনাভিজ্ঞতা ও রচনার প্রাচুর্যে স্বাতন্ত্র্য হয়ে উঠেছেন। শক্তি-তীক্ষ্মতা-অভিজ্ঞানই তাকে এ ধারায় হাঁটতে শিখিয়েছে। আশরাফ পিন্টুর প্রথম অণুগল্প পড়ি ‘ঢেউ’ পত্রিকার একটি সংখ্যায়, গল্পটির নাম ছিল-‘ছাগলপ্রেমিক’। এরপরে জাতিস্মর, চাতক, ঋত্বিকসহ বেশ কিছু লিটলম্যাগে, পর্যায়ক্রমে অণুগল্পগ্রন্থে। ২০১১ সালে তাঁর প্রথম অণুগল্পগ্রন্থ ‘থ’ প্রকাশিত হয়। মোট ১৫০ টি অণুগল্পের সম্ভার হাতে পেয়ে যেন ‘থ’ বনে যাই। এক সঙ্গে এত গল্পের সম্ভার বিস্ময়কর বটে! এটিই বাংলা সাহিত্যের প্রথম অণুগল্পগ্রন্থ।

আশরাফ পিন্টুর অণুগল্পগুলো পড়ার পর আমার বারবারই মনে হয়েছে-এই গল্পগুলো পড়ার জন্য আলাদা পাঠক দরকার। প্রচলিত ধারার পাঠক এই গল্প পড়তে পারবেন না বা শেষ করতে পারবেন না। অণুগল্পের আকার ছোট, কিন্তু একটি খাপের ভেতর যেন অজস্র গল্প চলে আসে, কোনটা তার আসল ম্যাসেজ তা চিন্তা করে খুঁজে নিতে হয় পাঠককে। সত্যিকার অর্থে কোন একক গল্প এখানে নেই। তারপরও সব মিলিয়ে একটা সম্পর্কসূত্র তৈরি করে তোলেন, সিরিয়াস পাঠক তা বুঝতে পারেন। তাঁর গল্প বিষয়ে এক কথায় বলা যায়- একটা চিকন খাট সংবেদনশীল দণ্ড; তাতে পিন্টু অজস্র আলপিন ফুটিয়ে দিচ্ছেন চারপাশ থেকে। অজস্র বিমূর্ত ডালপালা দিয়ে একটি বৃক্ষের মতো, তবে ডালপালাগুলো কাণ্ডের সাথে যুক্ত হবার কৌশল অভিনব। সময়, প্রেক্ষিত, চরিত্র, ইতিহাস, গল্প এবং কথকের কথকতা মিলে অদ্ভূত এক রসায়ন তৈরি হয়, যাতে আমাদের চেনা সমাজের ধুলো-কাদা-নির্বেদ-যন্ত্রণা নিয়ে শ্লেষের ঘোলাজল সবসময় খেলা করে। আশরাফ পিন্টুর অণুগল্প সম্পর্কে বিদগ্ধ সমালোচক সৈকত আরেফিন বলেছেন, ‘গল্পগুলো ক্রিকেটের ঘূর্ণি বলের মতো শেষে একটা বাঁক নেবে। যা কখনও ভেতরমুখী, কখনও বহির্মুখী। কিন্তু আপনাকে তা স্তম্ভিত করে দেবে’।
১০১টি অণুগল্প নিয়ে আশরাফ পিন্টুর অণুগল্পগ্রন্থ ‘অন্তরালের মুখোশ’ ২০১৩ সালের একুশের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। এটিকে ‘থ’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে। তবে গল্পগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ। ‘থ’ গ্রন্থের সাথে এর কোন যোগসূত্র নেই; তাই নামকরণেও নতুনত্ব আনা হয়েছে।
সমাজের বিভিন্ন বিষয়কে সাহিত্যের উপজীব্য করে শিল্পীতদৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন আশরাফ পিন্টু। এ পর্যায়ে বিচিত্রসন্ধানী ও জীবনদ্রষ্টা আশরাফ পিন্টুর অণুগল্পগুলোর আলোকে তার চেতনা ও প্রজ্ঞায় মানসলোক এবং সাহিত্যসৃষ্টিতে তার অবদান তুলে ধরবো।

মানুষ সব হারিয়ে সর্বশান্ত হয়ে আক্ষেপ করে। এই আক্ষেপের রেশ খানিকটা কাটাতে পারলেই দগ্ধ মন আত্মতৃপ্তি পায় যেন। ‘অগ্নিপিণ্ড আশরাফ পিন্টুর এরকমই একটি গল্প। আমাদের সমাজে এমন কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে যা বিশ্বাসযোগ্য নয়, কিন্তু সত্য। মাঝে মাঝে আমরা পত্রিকার পাতায় এ সমস্ত খবরের সন্ধান পাই। আশরাফ পিন্টু তাঁর ‘আজব হলেও গুজব নয়’ গল্পে ৬টি সংবাদ প্রকাশ করে আমাদের সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।

আমাদের দেশের রাজনীতিকরা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে নির্বাচনী এস্তেহার বেমালুম ভুলে যায়। জনগণের সামনে তাদের এই কলুষিত রূপ দেখাতে কোন অসুবিধে না থাকলেও নিজের চেহারা নিজে দেখলে একটু হলেও ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠে। তাই আয়নায় তাকাতে চায় না। ‘আয়নায় মুখ দেখা’ গল্পটির মাধ্যমে গল্পকার এ বিষয় সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন।

মানুষ অজ্ঞতা ও অকৃতজ্ঞতার মাধ্যমে মূল্যবান অনেক কিছুই অবলীলায় হারিয়ে ফেলে।‘ঈশপ প্রসঙ্গে’ এরকমই একটি গল্প।আমাদের মানবজন্মের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে- আমাদের জীবন একটি নাটকের দৃশ্য, যে নাটকের পরিচালক সৃষ্টিকর্তা নিজেই। ‘ইহা একটি নাটকের পটভূমি’ এরকমই একটি নাটকের গল্প।

প্রেম-ভালোবাসায় বিশ্বাস থাকতে হয়। বিশ্বাসহীন ভালোবাসা মরে যায়। প্রেমিক-প্রেমিকা প্রেমপত্রের মাধ্যমে নিজেদের ভালোবাসা একে অপরের প্রতি প্রতিষ্ঠা করে। প্রেমিক তার প্রেমিকা আশার প্রতি অসামান্য ভালোবাসা প্রকাশ করে চিঠির মাধ্যমে। এ রকম মনে হতে পারে ‘ইহা একটি প্রেমপত্র’ গল্পটি পড়ে। আসলে তিনি প্রেমিকার প্রতীকে আমাদের বেঁচে থাকার ‘আশা-আকাঙ্ক্ষার’ কথাকেই বুঝিয়েছেন।

প্রেম টিকে থাকে ততক্ষণ, যতক্ষণ প্রেমিক-প্রেমিকার একে অপরের প্রতি কৌতুহল থাকে। কৌতুহল শেষ হলে আকর্ষণও কমে যেতে থাকে। প্রেমের নামে ‘উত্তরাধুনিক প্রেম’ মানুষের ভালোবাসাকে অনুভূতিহীন করে তুলেছে।

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হয়েও ঘৃণ্য এই জন্য যে, নিজেদের ভুল নিজেরা কখনও স্বীকার করতে চায় না। মানব জীবনে সময় কম। তাই সময় থাকতেই শুধরে নেওয়া উচিত। ‘উবে গেল তার মানুষ হবার স্বপ্নসাধ’ গল্পটি মানুষের জন্য একটি শিক্ষা।
পার্থিব জীবনের আঙ্গিকে পরকালের পরিণতির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ‘একটি দেশের কাজকর্মের বৃত্তান্ত’ গল্পে।

পৃথিবীতে অভিনয়রত আদম সন্তান। সৃষ্টিকর্তার সার্বক্ষণিক নজরদারী, ভালোমন্দের হিসাব রাখার জন্য দায়িত্বরত দুই প্রহরীর নির্ভুল কার্যক্রম চলছে। ‘একটি সিনেমা তৈরির গল্প’র মত আমাদের এ জীবনের গল্প। ‘এনভেলাপ ও পোস্টকার্ডের কথোপকথন-১’ গল্পের মাধ্যমে আমাদের সমাজের স্বার্থান্বেষী মানুষের চরিত্র ফুটে উঠেছে। অর্থাৎ মানুষ এমন স্বার্থবাদী, সময়ের প্রয়োজনে আকড়ে ধরলেও স্বার্থ ফুরালে দূরে ঠেলে দিতেও দ্বিধা করে না।

সঠিক নেতৃত্বের কারণে আজ সমগ্র জাতি পথভ্রষ্ট। ‘ঐরাবত দলের প্রেসক্রিপশন’ গল্পে আমরা এ সত্যটি উপলব্ধি করতে পারি।

নিয়তি এমনই, কাকে কোথায় নিয়ে যাবে, তা কেউ বলতে পারে না। ‘ওরা চারজন’ গল্পের ফররুখ যেমন তার চলার সঙ্গীকে ফেলে যায়, নিয়তিও আমাদের কাউকে পেছনে ফেলবে আবার কাউকে নিয়ে যাবে সামনের দিকে এগিয়ে।

‘ঔরসজাত সন্তান’ কানা-গুজা-ন্যাংড়া হলেও জন্মদাতার কাছে আদরের। পিতামাতা সকল সন্তানের একই দাঁড়িপাল্লায় মাপে- যেমন মাপে সৃষ্টিকর্তা।

সবকিছুর গ্যারান্টি থাকলেও আমাদের বাঁচামরার গ্যারান্টি সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ দিতে পারে না। ‘গ্যারান্টি’ গল্পে গল্পকার কলমের কালি দ্বারা আমাদের জীবনের গ্যারান্টিকে তুলে ধরেছেন।মানুষ প্রতিনিয়ত প্রায় একইরকম জীবনযাপনে অভ্যস্ত। ফলে মাঝেমধ্যে কাজের খেই হারিয়ে ফেলে। কিন্তু একটু বদলের হাওয়া লাগলে ‘দুই প্রহরী’র মত বৈচিত্র্য আসবে জীবনে । স্বর্গ নয় মূলত মাটির পৃথিবীর প্রতি ভালোবাসাই ফুটে উঠেছে গল্পটিতে। মানুষের সকল অনুভূতিই তার ইচ্ছের উপর নির্ভরশীল। গোলাপ, হাসনাহেনা, গন্ধরাজ এর গন্ধ রেখেও কেউ কেউ পাতাবাহারের সুগন্ধ পেতে পারে। এটা একান্তই তার নিজস্ব।

দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে মানুষের সুখ-দুঃখ। মৃত্যু বেদনার হলেও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে কারো কারো কাছে সুখেরও হতে পারে। ‘মৃত্যু’ গল্পে গল্পকার একজন সন্ত্রাসীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ সত্যটি উপস্থাপন করেছেন। মানুষের জীবনযাপনের পারিপার্শ্বিকতার উপর নির্ভর করে মনের জোর। ‘স্বপ্ন’ গল্পে অনুভূতির দাবানল শেফালী বেগমের অভ্যস্ত জীবনের অনুদান। মানুষ নামের মুখোশপরা প্রতারক প্রাণী আমরা। আমাদের ‘ভেতর- বাহির’ ভিন্ন। বাইরে কেবল আনুষ্ঠানিকতার ছড়াছড়ি- ‘এক গ্লাসে দুই রকমের পানি’র মত।

একজন শিল্পী সমাজের উর্ধ্বে নয়। সমাজবাস্তবতাকে কেন্দ্র করে রচিত হয় সাহিত্যকর্ম। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক নানা বাস্তব ঘটনাকে লেখক যখন শিল্পসুন্দর দৃষ্টিতে উপস্থাপন করেন, তখনই তা সাহিত্যপদবাচ্য হয়ে ওঠে। গল্পকার আশরাফ পিন্টুর ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। তিনি চোখ বন্ধ করে গল্প লেখেন না, প্রতিবেশ ও পরিবেশের ভেতর ঢুকে জীবনকে দেখেন নির্মোহভাবে। এটাকে তার দীর্ঘ চর্চার ফল বলে মনে হয়। গল্পকার হিসেবে এখানেই তাঁর সার্থকতা।

একই রকম সংবাদ

বিজ্ঞাপনspot_img

সর্বশেষ খবর