পাক-ভারত উপমহাদেশে টিপ পরা প্রায় প্রতিটি নারীর জন্যই একরকম বাধ্যতামূলক বিষয় যেন ছিল। টিপ পরা শুধুমাত্র বাঙালি জাতির বা হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন ব্যাপার ছিল না। আঠারো শতকে তো টিপের ব্যবহার খুব সাধারণ হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে তখনকার ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বার্মা, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়ার নারীরা টিপ ব্যবহার করতেন। সেই সময় সব ধর্মের নারীদের মধ্যেই টিপ পরার প্রচলন ছিল। তখনকার মুসলমানদের মধ্যেও টিপ ব্যবহারের প্রচলন ছিল। ইসলামেও টিপ পরা নিষিদ্ধ করা হয়নি। টিপকে বরাবরই অঙ্গসজ্জার একটি অনুষঙ্গ হিসাবে দেখা হয়েছে। বিশেষ করে অনুষ্ঠানে যাওয়া, বিশেষ সাজগোজ করার সময় টিপকে শেষ উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করতো নারীরা। সব ধর্ম, সব শ্রেণির নারীদের মধ্যেই এই রীতি চালু ছিল। নারীরা যখন শাড়ি বা কোন রঙিন কাপড় ও একটা টিপ পরলে পুরো চেহারাটাই যেন বদলে যায়। শাড়ি বা কামিজের সঙ্গে টিপ পরলে অন্যরকম সৌন্দর্য ফুটে ওঠে চেহারায়। নারীদের নিজের কাছেই ভালো লাগে। তাই নারীরা বেশিরভাগ সময়েই টিপ পরে থাকে। কপালে টিপ বাঙালি তথা বাঙালি নারীর প্রাত্যহিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত ছিল। স্থান কাল আর পাত্র, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষ নারীরা পুরুষের তুলনায় সৌন্দর্য চর্চা করেন বেশি। বাঙালি নারীদের ক্ষেত্রে কপালে বড় একটি টিপ দেয়া, তার সৌন্দর্য চর্চার অন্যতম এক অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে।
আমাদের সমাজে এ প্রথাটা এলো কোথা হতে? এর উৎস খুঁজতে হলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে ইতিহাসের পাতায়, বাল্মীকি যুগে, এই রীতি চালু হয়েছে প্রায় ৯৫০০ থেকে ১১৫০০ বছর আগে থেকে, যাকে বাল্মীকি যুগ বলে বর্ণনা করা হয়ে থাকে।সেই সময় তৎকালীন হিন্দু সমাজে জাতিভেদ বা শ্রেণিভেদ প্রবল ছিল। ব্রাহ্মণরা উচ্চ শ্রেণির, তারা ঈশ্বরের অতি নিকটজন, পূত-পবিত্র। পবিত্রতার প্রতীক হিসাবে তারা কপালে সাদা তিলক (চন্দন তিলক) দিতেন। এখনও দেন। ক্ষৈত্রিয় হলো যোদ্ধা শ্রেণি, তাদেরকে বীর হিসাবে গণ্য করা হতো। ক্ষিপ্ততা, হিংস্রতা ও সাহসের প্রতীক হিসাবে তারা কপালে লাল টিপ দিতো। বৈশ্যয় শ্রেণির লোকজন হলো ব্যবসায়ী, পেশাই হলো ব্যবসা। এরা কপালে হলুদ রঙের টিপ ব্যবহার করতো। আর সমাজে সবচেয়ে নিচু লোকজন হলো শূদ্ররা। তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল কালো রঙের টিপ। তারা কপালে কালো টিপ ব্যবহার করতে বাধ্য হতো। নারীদের মধ্যেও ভিন্ন মাত্রার শ্রেণিভেদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। শ্রেণিভেদ অনুসারে তাদের বেলাতেও এই টিপ ব্যবহারে একটু ভিন্নতা ছিল। সেই সময় যেসব নারীদের মন্দিরে উৎসর্গ করা হতো, তাদের চিহ্নিত করার জন্যও টিপ দেয়ার রীতি চালু হয়েছিল। আবার উচ্চ বর্ণের বিবাহিত নারীরাও বিয়ের চিহ্নস্বরূপ কপালে সিঁদুরের টিপ পড়তেন। আঠারো বা উনিশ শতকের আগে অনেক সময় টিপ নারীদের শ্রেণি, মর্যাদা ইত্যাদির প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এরপর থেকে টিপ সবার কাছে সাধারণ সৌন্দর্য চর্চার একটি উপাদানে পরিণত হয়েছে। বিশ্বায়নের যুগে বাঙালির নিজস্ব টিপ এখন অবাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যেও সমান ভাবে জনপ্রিয়। অবাঙালি মেয়ে-বউরা ট্র্যাডিশনালের সঙ্গে বেশির ভাগ সময়ে টিপ পরেন।‘শান্তি’ ধারাবাহিকে শান্তি, ‘কহি কিসি রোজে’ রমোলা সিকান্দর, ‘কসৌটি জিন্দেগি কি’র কমলিকা — আসলে হিন্দি ধারাবাহিকের এই মুখগুলো ভুলে গেলেও কখনওই ভুলতে পারবেন না সিরিয়ালে এদের পরা ‘সিগনেচার’ টিপ বা বিন্দি। সাবেকি বিন্দিকে ‘ট্রেন্ডি’ করে তুলেছিল কিন্তু এই জনপ্রিয় ধারাবাহিকগুলি। বলাই বাহুল্য, হিন্দু সংস্কৃতির ধারা অনুযায়ী ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে নিজস্ব স্টাইলে বিন্দি পরার রীতি বহু পুরনো।
বঙ্গতনয়াদের মধ্যে টিপ পরার নতুন করে ঝোঁক বেশ চোখে পড়ার মতো। আগে শুধু কোনও বিশেষ দিনে শাড়ির সঙ্গেই সীমাবদ্ধ ছিল টিপের সাজ। কিন্তু শাড়ির চৌহদ্দি থেকে টিপকে অফিসে কর্মরত বা কলেজ-পড়ুয়া যুবতীদের রোজকার সাজে জনপ্রিয় করে তুলেছে ‘পিকুর’ দীপিকা। জিন্স-কুর্তি, কুর্তি-স্কার্ট-এই সবের সঙ্গে ছোট্ট ডট গোল টিপ আপনার সৌন্দর্যকে সম্পূর্ণ করতে পারে। ‘‘সেক্ষেত্রে ব্রাউন ছোট গোল টিপ সবচেয়ে ভাল। সব বয়সের সব মহিলাকেই এবং সব ফেসকাটিংয়েই এটা মানায়,’’ আনন্দবাজার পত্রিকায় বললেন মেক-আপ শিল্পী স্বরূপ সরকার।
আর টিপ পরা মানেই ‘রেট্রো’ লুকসও নয়। সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন করিনা কপূর। হ্যাঁ, ‘হিরোইন’ ছবিতে ‘হলকট জওয়ানি’ গানটায় করিনার সাজটা মনে করুন এক বার। খাটো করে পড়া কলকা পাড়ের গোলাপি রঙের শিমারিং শাড়ি, কালো শর্ট-স্লিভ নেটের ব্লাউস। আর ছোট্ট কালো গোল টিপ। অসম্ভব লাস্যময়ী লাগছিল তাঁকে। আর সম্প্রতি ‘পিকু’ ছবিতে কাজল-নয়না দীপিকাকেও তো দেখেছেন শাড়ির সঙ্গে কালো টিপ পরতে। তাই টিপ পরেও সমান ভাবে ‘সেক্সি’ ও ‘বোল্ড’ দেখাবে আপনাকে। শুধু চাই রাইট অ্যাটিটিউড।
গোল– বড় গোল টিপ একেবারে নয়, ছোট গোল টিপ চলতে পারে। লম্বা টিপ বেশি ভাল মানাবে।
ডায়মন্ড– চওড়া কপাল, পয়েন্টেড চিবুক- বড় টিপ একেবারে নয়। ছোট গোল টিপ।
ডিম্বাকার– সব টিপই মানাবে। তবে বেশি লম্বা টিপ না পরাই ভাল।
বর্গাকৃতি– ভি-শেপড বিন্দি বা ছোট গোল টিপ
আয়তাকার– সব সাইজ ও শেপের টিপ মানাবে।
পুজোঃ
• সকাল– কুর্তির সঙ্গে ছোট গোল টিপ, মেক-আপ নমিনাল বেস, চোখে কাজল আর হাল্কা লিপস্টিক।
• অষ্টমীর সকাল-লাল-পাড় সাদা শাড়ির সঙ্গে লাল টিপ। চোখে ঘন করে কাজল। কপাল চওড়া হলে টিপটা সাবেকি স্টাইলে একটু উঁচু করে পরা যেতে পারে। তবে মুখের শেপ ও সাইজ অনুযায়ী টিপ নির্বাচন করতে হবে।
• নবমী বিকেল- সিকুইন শাড়ির সঙ্গে গ্লিটারিং বিন্দি।
• ওয়েস্টার্ন- অ্যাবস্ট্র্যাক্ট আর্ট বিন্দি স্টাইল
• বিন্দি ট্যাটু- ট্রেন্ডে নেই, কিন্তু করতে চাইলে প্রফেশনাল শিল্পীকে দিয়ে করালে ভাল।
কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৌমিত্র শেখর দে বিবিসিকে বলছেন, ”টিপকে এখন মানুষ সৌন্দর্য হিসাবে ব্যবহার করে। কিন্তু এই টিপের একটা প্রতীকী ব্যাপার আছে। সেটা হচ্ছে, ব্যক্তির ‘থার্ড আই’ হিসাবে এটাকে চিহ্নিত করা হয়। এটা হচ্ছে দূরদৃষ্টি প্রকাশক। এটা সিম্বোলিক হয়ে ধীরে ধীরে টিপ-এ পরিণত হয়েছে।” তিনি বলেন, “তৃতীয় চক্ষুর এই ব্যাপারটিকে সমাজ ধীরে ধীরে সৌন্দর্য হিসাবে সমাজ গ্রহণ করেছে এবং আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। সেটা হয়েছে বহু আগে থেকে। বলা যায়, প্রাচীন, মধ্যযুগ অতিক্রম করে এটা সাম্প্রতিক কালে এসে পৌঁছেছে।” তথ্য সুত্রঃ বিবিসি বাংলা, আনন্দবাজার পত্রিকা।